দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৭

ষষ্ঠ পর্বের পর

পঁচিশে অক্টোবর, ষষ্ঠ দিন

কনকনে ঠাণ্ডায় ভোর পৌনে পাঁচটায় লেপের নিচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকাটা সোজা, নাকি গুরুদোংমারের ডাকে সোজা লেপ টেপ ঝেড়ে ফেলে রেডি হওয়াটা সোজা?

অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করেও এর সঠিক উত্তর খুঁজে পেলাম না। সাড়ে চারটেয় অ্যালার্ম বেজে গেছে। কাল যেহেতু রাত প্রায় সাড়ে নটা থেকেই ঘুমোচ্ছি, ফলে ঘুম ভাঙতেও অসুবিধে হয় নি, কিন্তু মুণ্ডু বের করেই বুঝলাম হাড়কাঁপানো শীত। ঘরের ভেতরেই এই, বাইরে নিশ্চয়ই দুত্তিন ডিগ্রি মত হবে। বেরোতে হবেই, লেটেস্ট বাই সাড়ে পাঁচটা বেরোতে হবে, নইলে সাড়ে সাতটার মধ্যে থাঙ্গুতে রিপোর্ট করা চাপ হয়ে যাবে। তাই প্রথমে মুণ্ডু, তার পরে বাঁহাতের কড়ে আঙুল – এইগুলো এক এক করে লেপের থেকে বের করে ঠাণ্ডাটা আস্তে আস্তে সইয়ে নিচ্ছিলাম, এমন সময়ে দরজায় ধাক্কা পড়ল। ছিরিন, ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে।

উঠতেই হল। তড়াক করে উঠে দরজা খুললাম, হিমেল হাওয়ার একটা ঝটকা আমাকে একবার আপাদমস্তক মেপে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। পাঁচটা বাজতে পাঁচ। ছিরিন নিয়ে এসেছে গরম গরম স্লাইস ব্রেড, ওমলেট, জ্যাম আর কফি।

স্তুপের নিচ থেকে অনুপকে আবিষ্কার করলাম, সে উঠেই মোজা পায়ে গলিয়ে চটি পরে বাথরুমে ঢুকে গেল। ‘ফ্রেশ’ হতে হবে। এদিকে আমার আবার ছোটবেলা থেকে এই সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হবার বাধ্যবাধকতা টাইপের অভ্যেস নেই। যখন সময় সুযোগ পাই, দরকার মনে হয়, ফ্রেশ হয়ে নিই। সুতরাং, অনুপ মনের আনন্দে ‘ফ্রেশ’ হয়ে যখন বেরোল, আমার খাওয়া ততক্ষণে শেষ, এবং অনুপের ভাগের অমলেট কফি প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

অনুপ প্রায় কিছুই খেল না – ‘ম্যান, ইচ্ছে করছে না। লেটস গো’ বলে অর্ধেক পাঁউরুটি ছেড়ে জুতো পরতে শুরু করে দিল। আমার ততক্ষণে আমার মতন করে ‘ফ্রেশ’ হয়ে নিয়ে (মানে শুধু দাঁত মেজেছিলাম) জুতো পরাও শেষ। আজ তো কোনও লাগেজ নিয়ে যাবার নেই, সব রেখেই যাবো, ফিরতি পথে এখানেই লাঞ্চ করে আবার লাগেজ বেঁধে নিয়ে আমি চলে যাবো লাচুং, আর অনুপ চলে যাবে গ্যাংটকের দিকে। জাস্ট পিঠের ব্যাগে পারমিটের চিঠি, স্লিপ, আর তার বাকি ফোটোকপি ইত্যাদি নিয়ে বেরোতে গিয়েও কী মনে হল, ওষুধের প্যাকেট থেকে ডায়ামক্সের স্ট্রিপটা বের করে নিয়ে ব্যাগে ঢোকালাম। বাকি সব থাক।

ছিরিন বলল, কাল কলকাতা থেকেও আরেকটা বাইকারদের গ্রুপ এসেছে, ওরাও তৈরি হচ্ছে, একটু পরেই বেরোবে। আমি বললাম, তা হলে জেনে এসো না, এক্ষুনি বেরোবে না টাইম লাগবে। পাঁচ দশ মিনিট মতন ওয়েট করতে পারি, পাঁচটা পঁচিশ বাজে এখন। – ছিরিন খোঁজ নিয়ে এসে বলল, না, ওদের বেরোতে বেরোতে পৌনে ছটা বা ছটা বাজবে।

অতএব, আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। ভারতের পূর্বদিক, তাই এখানে সবেমাত্র সূর্য উঠে গেছে, চারপাশে একটা গাঢ় নীলচে ভাব ক্রমে সোনালি, তারপরে রূপোলি সাদা হয়ে উঠছে। গাছপালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে লুকোচুরি খেলছে মেঘ বা কুয়াশারা – তার মাঝখান দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সকালের প্রথম সূর্যের কিরণ। দু দণ্ড না দাঁড়িয়ে এর শোভা উপভোগ করি কেমন করে?

20171025_060931.jpg

ঠিক এইটাই, এইটাই কারণ সাড়ে পাঁচটায় বেরনোর। প্রথম রিপোর্টিং থাঙ্গু-তে পুলিশ চেকপোস্টে, সেটা এখান থেকে মাত্র বত্রিশ কিলোমিটার দূরে, সেইখানে রিপোর্টিং টাইম সকাল সাড়ে সাতটা, কিন্তু দু ঘণ্টা সময় হাতে রেখে বেরোতে হয় তার একটা কারণ হল এইটা। বত্রিশ কিলোমিটার গড়গড়িয়ে চলে যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না – অসম্ভব সৌন্দর্য তোমাকে প্রতিটা বাঁকে বাঁকে দাঁড় করাবেই। গাছপালা পাহাড়ের বাঁক সামনের আঁকাবাঁকা রাস্তা – সবাই কেমন অলস হয়ে সকালটা উপভোগ করছে মেঘকুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে, তার মাঝখান দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে মন চায় না। দাঁড়াতেই হয়।

অবিশ্যি, সময় বেশি লাগার আরও একটা কারণ আছে।

রাস্তা।

লাচেনের পরে প্রায় গুরুদোংমার পর্যন্ত রাস্তাটা প্রায় নেই-রাস্তা বললেই চলে। কাদা, মাটি, পাথর, আর পাথর-মাটি-কাদা। বাইক আজ খালি, লাগেজবিহীন, ফলে একেকটা পাথরের ওপর পড়ে বা গর্তের মুখে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে – সে এক প্রাণান্তকর, কিন্তু রীতিমত এনজয়েবল অভিজ্ঞতা। চারপাশের প্রকৃতির থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না, তার ফল হিসেবে পরের গর্তে চাকা পড়ে লাফিয়ে উঠছে মোটরসাইকেল – সময়ে দেখতে পাই নি। আবার পথের দিকে মন দিলে চারপাশের দৃশ্য মিস হয়ে যাচ্ছে।

হোটেল থেকে খানিকটা মোটামুটি ভালো রাস্তা। দুদিকে ছোটখাটো দোকান, আর হোটেল। একটা হোটেল থেকে দেখলাম চার পাঁচটা মোটরসাইকেল বাঁধাছাঁদা করে বেরোবার তোড়জোড় করছে। মোটরসাইকেলগুলোর নম্বর কেরালার।

এখান থেকেই বাঁদিকে আরেকটা পায়ে চলা রাস্তা চলে গেছে। এটা ট্রেকিং রুট। গ্রীন লেকের দিকে যাবার। মোটরসাইকেল সে রাস্তায় নিয়ে যাওয়া যায় না।

খানিক চলার পরেই দেখি ঠাঁই-ঠং-ঠঙাস করে একটা আওয়াজ এল আমার বাইকের পেছন দিক থেকে। তড়িঘড়ি বাইক থামিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। অনুপ এগিয়ে গেছে খানিকটা, কীসের আওয়াজ? – দেখি, একটা কালো রঙের রড পড়ে আছে রাস্তার ওপর। সেটা খুলে বেরিয়েছে আমার ক্যারিয়ারের পেছন থেকেই। আমার বাইকে লাগানো ক্যারিয়ারটা তো ডি-অ্যাসেম্বল করা যায়, বিভিন্নপ্রকার নাটবল্টু দিয়ে শক্ত শক্ত লোহার ফ্রেম রড দিয়ে বানানো এটা – ঝাঁকুনির চোটে নাট ঢিলে হতে হতে একসময়ে একটা রড পেছন থেকে খসে পড়েছে। দৌড়ে গিয়ে রডটা কুড়িয়ে আনলাম। ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে লোকেটও করতে পারলাম ঠিক কোন জায়গা থেকে খুলেছে ওটা, কিন্তু ঝাঁকুনির ইমপ্যাক্টে নাটবল্টুগুলো কোথায় খুলে পড়ে গেছে – সে আর পাওয়া গেল না।

ক্যারিয়ারের একদম পেছনদিকে, সীটের পেছনটায়, যেখানে স্লিপিং ব্যাগ আর ত্রিপলের প্লাস্টিক ভাঁজ করে রাখা ছিল, সেইখানে পরপর দুটো লোহার রড দিয়ে প্যারালালি আটকেএকটা বেস বানানো ছিল। তার একটা খুলে বেরিয়ে এসেছে, অন্যটার একদিকের নাটবল্টু খুলে হাওয়া, এবং অন্য দিকটাও ঢলঢল করছে, যে কোনও মুহূর্তে সে-ও খুলবে। করোল বাগে সাঙ্ঘাতিক টাইট করে যে সব জিনিস ফিট করা হয়েছিল, তারা এখন এতটাই লুজ হয়ে গেছে যে আমি হাতে করে নাট ঘুরিয়ে বাকিটা খুলে ফেললাম। দুটো রডই ব্যাগের ভেতর চালান করে আবার একবার পুরো ক্যারিয়ার ফ্রেমটা ভালো করে নেড়ে ঝাঁকিয়ে দেখে নিলাম। নাঃ, বাকিটা পোক্ত আছে বলেই মনে হচ্ছে।

20171025_075037.jpgDSC_0172.jpgDSC_0174.jpg

সাড়ে সাতটার একটু আগেই থাঙ্গুর চেকপোস্টে পৌঁছে গেলাম। তিন চারটে বাড়ি, আর একটা পুলিশ পোস্ট, যাবার সময়ে ডানদিকে পড়ে। বাকি আর্মির এসট্যাবলিশমেন্ট। অনুপ তো আমার আগেই এগিয়ে গেছিল – সে কই? কোথাও তো দেখছি না, ভাবতে ভাবতেই অনুপ এসে হাজির হল, কখন পিছিয়ে পড়েছিল – খেয়াল করি নি। কী রকম একটু কাহিল লাগছে তাকে। আমরা পারমিটের কপি জমা করলাম পুলিশের কাছে, রাস্তা সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে জানলাম, পুরো রাস্তাই এই রকমেরই খারাপ, কেবল গুরুদোংমারের আগে এগারো কিলোমিটার রাস্তায় ঠিকঠাক পিচ টিচ আছে।

অনুপ উবু হয়ে বসে পড়েছে তার মোটরসাইকেলের সামনে। গ্লাভস পরা দুই হাত ঠেসে ধরেছে ইঞ্জিনের ওপর, সাইলেন্সারের ওপর। ঠাণ্ডা ওর প্রচণ্ড লাগছে, আর তাতে ও একেবারে কুপোকাত। এত ঠাণ্ডা ও জাস্ট সহ্য করে উঠতে পারছে না। আমার অল্প হলেও অভ্যেস আছে, ফলে শীত করলেও সেটা অসহনীয় লাগছে না, কিন্তু অনুপের একেবারেই অভ্যেস নেই। ঠকঠক করে কাঁপছে আর ইঞ্জিনের গরমে হাত সেঁকে গরম হবার চেষ্টা করছে। আরও পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার যাবার আছে, পারবে তো?

খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম ওর সাথে। অনুপই বলল, ব্রো, ডোন্ট ওয়েট ফর মি, আমি চলে যাবো। তুমি এগোও, আমি রাস্তায় তোমাকে ধরে নেব।

আমি তাও দুবার ওকে জিজ্ঞেস করে নিলাম, সব ঠিক আছে তো? এমন কিছু দেরি হয় নি, দরকার হলে তুমি আরেকটু গরম নিয়ে নাও – আমি দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু অনুপ বলল, দরকার নেই – ও আরেকটু হাত সেঁকে নিয়েই এগোবে।

অগত্যা আমি একাই এগোলাম আবার। এবার উচ্চতা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে, একেকটা বাঁকে রাস্তা একদম হুশহাশ স্বর্গের দিকে উঠে যাচ্ছে। বাইকটা নেহাত লাগেজবিহীন, তাই কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না।

গাছপালার সংখ্যা কমে এসেছে। জায়গায় জায়গায় উজ্জ্বল হলুদ বা কমলা বা খয়েরি রঙের ঝোপ। ঝাঁকে ঝাঁকে রঙের সমাহার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। খানিক এগিয়ে চোখে পড়ল দূরে একটা উপত্যকা মত, হাল্কা বরফে ছেয়ে আছে, আর তার মাঝে একলা একটা সেতু, বোধ হয় কোনও নালা আছে ওখানে, এখন জমে বরফ। চারপাশে জনপ্রাণী নেই। যতদূর চোখ যায়, আমি একা।

20171025_083534.jpg

নটা পনেরো নাগাদ পৌঁছলাম গিয়ে সেই আর্মি চেকপোস্টে। এখানেই লাস্ট কাগজপত্র দেখাতে হয়। চিঠি জমা দিতে হয় – এর পর থেকেই এগারো কিলোমিটার ভালো রাস্তা – তার শেষেই নাকি গুরুদোংমার। কিন্তু কোথায় ভালো রাস্তা? চেকপোস্টের ব্যারিকেডের এপার থেকে উঁকি মেরে যতদূর দেখলাম, একই রকমের ভাঙাচোরা অফরোড।

DSC_0177.jpg

বাইক সাইডে দাঁড় করিয়ে চিঠি জমা করতে গেলাম। ভেতরে একটা চুল্লি মতন ব্যবস্থা জ্বলছে, মানে লোহার একটা বড় পাত্রে আগুন জ্বলছে, বোধ হয় তেলে জ্বালানো হচ্ছে, আর তার ওপর থেকে একটা চিমনির মত নল বেরিয়ে গেছে ছাদের দিকে। সকালে দেখা কেরালার ছেলেগুলো কখন আমাদের ওভারটেক করে এগিয়ে গেছে – তারা ছিল, আর দু তিনটে ট্যুরিস্ট ক্যাব ছিল। ঝটপট চিঠি জমা করা হয়ে গেল, ভেতরে জমা নেওয়া আর্মি জওয়ান বলল, সব পারমিট আর চিঠি এখানে জমা করে দাও, ফেরার সময়ে নিয়ে যাবে। সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরতে হবে, নইলে কিন্তু ডকুমেন্ট ফেরত পাবে না।

সাড়ে বারোটা বেজে এক মিনিট হয়ে গেলে আমি ফেরত আসতে পারব কিনা জানবার আগেই আমার ডকুমেন্ট জমা হয়ে গেল, একটা রাবার ব্যান্ডে আটকে আমাকে জানানো হল, আমার নম্বর বারো। মানে, এসে বারো নম্বর বললেই এই বান্ডিলটি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, যাতে সমস্ত বাকি পারমিট, স্লিপ, ফোটোকপি ইত্যাদি রয়েছে।

বেশ। বারো নম্বর নিয়ে বেরোলাম ঘর থেকে। ঠাণ্ডাটা কাঁপাকাঁপি, কিন্তু বড়ই মনোরম। সামনেই একটা আর্মি কাফেটেরিয়া। এত ঝাঁকুনি খেয়েছি এই ষাট কিলোমিটার – সকালের ব্রেকফাস্ট কখন হজম হয়ে গেছে। কী পাওয়া যায় দেখি – অনুপ তো এখনও এসে পৌঁছয় নি।

ক্যাফেটেরিয়াতে মোমো চাউমিন আলুপরোটা সবই পাওয়া যাচ্ছে, আর পাশে দুটো বড় বড় ফিল্টারে জল আর কফি রাখা আছে, আরেকগুচ্ছ ফাইবারের গ্লাস পাশে উপুড় করে রাখা। কফি, গুরুদোংমারে আগত সমস্ত যাত্রীদের জন্য আর্মির তরফ থেকে ফ্রি! গ্লাসে নাও, কফি খাও, এবং হয়ে গেলে পাশের ফিল্টার থেকে জল ঢেলে গ্লাস ধুয়ে আবার উপুড় করে দাও। সেলফ হেল্প। বাকি আইটেমের জন্য ফেলোকড়িমাখোতেল।

কফি খেলাম এক গ্লাস। বেশ আরাম, যদিও কফিটা মোট্টেও ভালো খেতে ছিল না। কিন্তু অনুপ কেন আসে না? এখানে ফোনের নেটওয়ার্কও নেই, কল করা যাবে না। কেরালার গ্রুপটা বেরিয়ে গেল। তিনটে টাটা সুমোভর্তি ট্যুরিস্ট চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সাড়ে নটা বাজছে, নটা চল্লিশ। আরও দুটো ট্যুরিস্ট ক্যাব এল। ধড়ফড় করে এক ভদ্রলোক তাঁর মা-কে নামালেন। ভদ্রমহিলাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি এএমএসে আক্রান্ত হয়েছেন, হাঁ করে করে শ্বাস টানছেন। দুজন আর্মি জওয়ান ছুটে এল, সামনে বাঁদিকেই মেডিকেল চেকআপ ক্যাম্প, সেইখানে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল ভদ্রমহিলাকে। আরও কয়েকজন নিজেদের প্রায় ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে চলল সেদিকে। … আমি নিজের বুকপকেটে একবার হাত বোলালাম। আছে, ডায়ামক্সের স্ট্রিপটা আছে। যদিও একেবারেই কোনও সমস্যা হচ্ছে না আমার। আমাকে এএমএস অ্যাটাক করে না। তবুও …

তিনটে মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল। পশ্চিমবঙ্গের নাম্বারপ্লেট। সামনের জন, অবভিয়াসলি বাঙালি, একদম বাংলা অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, সাদা রঙের অ্যাপাচে আরটিআর, কর্ণাটকের নম্বর, ও কি তোমার সঙ্গে আসছিল?

আমার বুকটা ধক করে উঠল – হ্যাঁ, কেন? কোথায় সে? কী হয়েছে?

প্রশ্নগুলো বাংলাতেই করলাম। বাঙালির সাথে ইংরেজিতে কথা চালাবার কোনও মানেই হয় না। ছেলেটা বলল, ও বোধ হয় খুব অসুস্থ। বমি হয়েছে দু একবার। বলল ধীরে ধীরে আসছে, এখনও বোধ হয় পাঁচ-ছ কিলোমিটার পেছনে আছে।

অসুস্থ? কী হয়েছে – কে জানে! আমি কি পিছিয়ে গিয়ে দেখব, নাকি এখানেই ওয়েট করব? আমি ভাবতে থাকলাম, ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় দেখলাম অনুপ আসছে ধীরে ধীরে। কোনও রকমে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে ওকে ধরে ধরে নিয়ে গেলাম ঘরের ভেতর, যেখানে পারমিটের চিঠি জমা হচ্ছে। ধরে ধরে বসিয়ে দিলাম সেই চুল্লির সামনে। অনুপ পারলে প্রায় চুল্লির আগুনেই হাত ঢুকিয়ে দেয় আর কি। আমি ওর কাছ থেকে ওর কাগজপত্র নিয়ে জমা করলাম, নম্বর নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? অনুপ বলল, সকাল থেকেই শরীর খারাপ লাগছে, এক তো প্রচণ্ড শীত, তার ওপর বোধ হয় ফুড পয়জনিং হয়েছে, ডাইজেশনের সমস্যা হচ্ছে। তোমার কাছে কোনও ওষুধ আছে?

আছে তো! নরফ্লক্স নিয়ে এসেছি – কিন্তু সে তো হোটেলেই রেখে এসেছি, এখন আমি স্রেফ ডায়ামক্স নিয়ে বেরিয়েছি। পেট খারাপের ওষুধ এখানে লাগতে পারে, সেটা তো আগে ভাবি নি! বললাম, শোনো, একটু হেঁটে চলো, এই সামনেই এদের মেডিকেল ক্যাম্প, ওখানে পেয়ে যাবে।

নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনও রকমে হেঁটে গিয়ে অনুপ ঢুকল মেডিকেল ক্যাম্পে, আমিও ঢুকলাম পেছন পেছন। পরপর দুটো সারিতে কিছু খাট পেতে রাখা – প্রত্যেকটার পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। অনুপ গিয়ে ধপ করে একটা খাটে কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়ল। একজন আর্মিম্যান ওকে শুশ্রূষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রথমে মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ওপরে দু প্রস্থ কম্বল। প্রায় দশ মিনিট অক্সিজেন নেবার পরে মনে হল একটু সুস্থ হয়েছে। ডাক্তার এলেন বেডের কাছে – লুজ মোশন কন্ট্রোল করার জন্য দুটো ট্যাবলেট চেয়ে নেওয়া হল। আবারও দশ মিনিট অক্সিজেন।

প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে অনুপ বলল, না, আমি উঠতে পারব। আমি বললাম, এক কাজ করো না – তুমি এখানেই রেস্ট নাও। আর এগোতে হবে না, সামনে তো আরও অলটিট্যুড বাড়বে, শরীর খারাপ করতে পারে। আমি ঘুরে আসি – তুমি আমার সঙ্গেই ফিরবে। …কিন্তু যে ছেলে ব্যাঙ্গালোর থেকে এতদূর এসেছে মোটরসাইকেল চালিয়ে গুরুদোংমার দেখবে বলে – সে আর এগারো কিলোমিটার না চলে ফিরে যাবে, জাস্ট শরীর খারাপ বলে? অনুপ বলল, না, আমি ঠিক আছি, আমি যাবো।

ওকে বের করলাম মেডিকেল ক্যাম্প থেকে। ক্যাফেটেরিয়াতে নিয়ে গিয়ে কফি খেতে দিলাম, সাথে সেই ডাইজেশনের ওষুধ, আর আমি দিলাম একটা ডায়ামক্স। বললাম, হোটেলে ফিরলে নরফ্লক্স দেব। ওটা আলটিমেট।

কফি খেয়ে, ওষুধ খেয়ে আমার মোটরসাইকেল অবধি ফিরে আসার আগেই অনুপ লাফিয়ে উঠল মোটরসাইকেলে, বলল, আমি আগে আগে বেরিয়ে যাচ্ছি, গুরুদোংমার টাচ করেই আমি ফিরব হোটেলে। একদম হোটেলে গিয়ে কথা হবে, কেমন?

ব্যারিকেডের কাছে একজন হাবিলদার দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম – এই খারাপ রাস্তা আর কতদূর আছে? ভদ্রলোক হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশি না, এই দুশো মিটার, তার পরে বঢ়িয়া রোড পাবেন।

সোয়া নটায় ঢুকেছিলাম, অনুপের চক্করে পড়ে বাজে এখন বেলা এগারোটা। সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরতে হবে। আর কালবিলম্ব না করে আমি মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে এগোলাম, এবং সত্যিই দুশো মিটার পরে দেখলাম একদম সেই রানওয়ের মত রাস্তা, মসৃণ ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট। লেখা আছে, গুরুদোংমার, এগারো কিলোমিটার। সকাল থেকে এই প্রথম ষাটের ওপর স্পিড তুলতে পারলাম। দেখতে দেখতে দশ কিলোমিটার শেষ হয়ে গেল, তার পরে রাস্তা আরও চলে গেছে সোজা, কিন্তু রাস্তার ডানদিকে একটা অ্যারোমার্ক সমেত ছোট্ট বোর্ড, গুরুদোংমার লেক, এইদিকে।

20171025_110802.jpg

রাস্তা ছেড়ে আবার অফরোডিং। শেষ এক কিলোমিটার চড়াই ছিল মারাত্মক। একবারের জন্য বাইকের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে উল্টোদিকে গড়িয়ে পড়ে নেমে আসা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। গোঁ-গোঁ শব্দে মোটরসাইকেলের প্রচণ্ড অপছন্দ অস্বীকার করে আমি চলতে শুরু করলাম, প্রায় মাথা-সমান উঁচু খাড়াই, জাস্ট চাকার দাগ ধরে ধরে এগনো, রাস্তা বলে কিছু নেই, এটুকু বুঝছি, একটা পাহাড়ের মাথায় চড়ছি মোটরসাইকেল নিয়ে।

চড়াই শেষ হওয়ামাত্র, আমার দু চোখ ভরে এল নীল রঙে। সামনে সুনীল জল নিয়ে বেলা সাড়ে এগারোটার সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে গুরুদোংমার লেক। ওপরে কোবাল্ট ব্লু কালারের আকাশ। আর চারদিকে প্রহরীর মত ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বরফঢাকা পাহাড়ের চূড়োরা, এত কাছে, মনে হল হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। মুগ্ধতায় কথা হারিয়ে যায়, সে এমন সুন্দর।

DSC_0180.jpg20171025_105306.jpg

অনুপ তখন ক্যামেরা ব্যাগে ভরে ফেরার তোড়জোড় করছে। ওকে দাঁড় করিয়ে আমার দু একটা ছবি তুললাম। অনুপ তুলে দিয়েই বলল, ভাই, আমি এবার নামি, মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড। হোটেলে ফিরে রেস্ট নিচ্ছি, তুমি এসো ধীরেসুস্থে। ওখানে দেখা হবে।

DSC_0182.jpgDSC_0184.jpg

অনুপকে বিদায় জানিয়ে আমি খানিক বসলাম ওখানে। বাঙালিদের দলটা একটু দূরে হইহল্লা করে সেলিব্রেট করছে, ফটো তুলছে। আমি একদৃষ্টে চেয়ে থাকলাম নীল জলের দিকে। অনেকদিন আগে, প্যাংগংয়ে এই রকমের নীল দেখেছিলাম। …

20171025_105346.jpg20171025_105511.jpg

গুরুদোংমারের জলের কাছে যাবার বোধ হয় কোনও একটা রাস্তা আছে, নিচের দিকে জলের ধার ঘেঁষে পায়ে চলা রাস্তা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সে কোথা থেকে নামে, বোঝা গেল না। সময়ও শেষ হয়ে আসছে। পৌনে বারোটা বাজে। সাড়ে বারোটার মধ্যে সেই আর্মি চেকপোস্টে ফিরতে হবে, অরিজিনাল ডকুমেন্ট ফেরত নেবার জন্য। দশ কিলোমিটার যেতে পনেরো মিনিট মত লাগবে। একবার কি চোলামু ট্রাই করব না? পারমিট নেই অবশ্যই – যদি আটকায়, ফিরে আসব, তবু, মাত্র ছ কিলোমিটার দূরত্বে আরেকটা লেক না দেখে ফিরে আসব? যাইই না, ট্রাই করি।

আসল নাম সো লামো। তিব্বতী ভাষায় সো মানে লেক, হ্রদ। প্যাংগং সো, সো মোরিরি ইত্যাদি। সো লামো কথ্য ভাষায় চোলামু হয়ে গেছে। লেকের ইতিহাস-টাস লিখছি না এখানে, কারণ ওগুলো উইকি করলেই পাওয়া যায়। এটা একেবারে তিব্বত বর্ডারে অবস্থিত বলে পারমিট দেওয়া হয় না এখানে আসার, তবু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? দিল্লি থেকে প্রায় দু হাজার কিলোমিটার চালিয়ে এতদূর এসেছি, আর ছ কিলোমিটারের জন্য একবার চেষ্টা করব না?

গুরুদোংমারকে বাই বাই করে নেমে এলাম পাকা রাস্তায়। এবার বাঁদিকে মিলিটারি চেকপোস্টের দিকে না গিয়ে ডানদিকে টার্ন নিলাম। ত্রিসীমানায় কোথাও কেউ নেই। অনেকটা এগোবার পর দূরে একটা লেকের মত কিছু মনে হল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তার আগেই একটা ব্যারিকেডের মত গেট, এবং সেখানে দুজন আর্মির লোক দাঁড়িয়ে। আমাকেও সেখানে গিয়েই দাঁড়াতে হল। পেপার দেখানোর গল্পই নেই, কারণ পেপার সমস্তই গুরুদোংমারের এগারো কিলোমিটার আগের চেকপোস্টে জমা করে রাখা আছে। একবার রিকোয়েস্ট করলাম, জাস্ট চোলামু দেখেই ফিরে যাবো, বাইকের নাম্বারপ্লেট দেখিয়ে বললাম, দিল্লি থেকে এতটা এসেছি। কিন্তু মিলিটারি কথা শুনবে না, সে জানাই ছিল, শুনলও না। জাস্ট ওখানে দাঁড়িয়ে দূরে একটা লেকের এক চিলতে দেখতে পেলাম, সম্ভবত সেটাই চোলামু। জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাওয়া গেল না, আমাকে বার বার বলা হল ফিরে যেতে। তো, ঐটুকু দেখেই বাইক ঘোরাতে হল।

ঠিক সাড়ে বারোটায় আগের চেকপোস্টে ফিরে এসে কাগজপত্র ফেরত নিয়ে লাচেন ফেরার রাস্তা ধরলাম। সেই একই হাড়ভাঙা ঝাঁকুনির রাস্তা। থাঙ্গু ঢোকার একটু আগে মনে হল এবার আমার মোটরসাইকেল ক্যারিয়ারের ডানদিকটা থেকেও কেমন যেন আওয়াজ বেরোচ্ছে। দাঁড়ালাম – সে মানে এমনই এবড়োখেবড়ো যে ঠিকমত স্ট্যান্ডও দেওয়া যাচ্ছে না মোটরসাইকেলে। হ্যাঁ, ডানদিকের ফ্রেম যেখানে বাইকের পেছনদিকে মোটা স্ক্রু-নাট দিয়ে কষে বাঁধা, সেই স্ক্রু-নাটও ঢিলে হয়ে আসছে – যদিও খুলবে না। আমার কাছে স্ক্রু টাইট করার মত কিছুই নেই, হাতে করেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম, খানিক ঘুরল, কিন্তু আওয়াজ তাতে কমল না, তবে এটুকু দেখে বোঝা গেল যে খুলে বেরিয়ে আসবে না। কোনওরকমে লাচেন পৌঁছতে পারলে হয় এবার – কষে লাগেজের সঙ্গে ফ্রেমটাকে বাইকের সাথে পেঁচিয়ে বানজি কর্ড দিয়ে বেঁধে ফেললে আর আওয়াজ করবে না।

থাঙ্গুর কাছে দেখি একটা ছোট্ট দোকানের সামনে সেই টাতা সুমোটা দাঁড়িয়ে আছে, যে গাড়ির বয়স্কা মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দেখে আমিই দাঁড়ালাম। মহিলার ছেলে এগিয়ে এলেন। মায়ের শরীর এখনও ঠিক হয় নি। আমি বললাম, তা হলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যান। আপনাদের আজ কোথায় বুকিং আছে?

ভদ্রলোক বললেন, আজ তো গ্যাংটক ফেরত যাবার ছিল – কিন্তু কী করে যাই – মায়ের অসম্ভব মাথায় যন্ত্রণা করছে।

আমি বললাম, কাঁচি আছে?

– আজ্ঞে?

– কাঁচি ব্লেড – যা হোক একটা দিন, আমি আমার স্ট্রিপ থেকে দুটো ডায়ামক্স কেটে দিচ্ছি।

দোকান থেকেই একটা কাঁচি এনে দুটো ডায়ামক্স ওঁকে দিলাম, বললাম, কিছু একটা খাইয়ে এক্ষুনি এটা খাইয়ে দিন, আর যত নিচে নামবেন, তত ঠিক বোধ করবেন উনি – এর আর কোনও চিকিৎসা নেই। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, যত কষ্টই হোক, আপনারা নিচে নামতে থাকুন।

20171025_134824.jpg

সাড়ে তিনটের সময়ে লাচেনে ঢুকলাম। ছিরিন আমার জন্য দাঁড়িয়েই ছিল। কলকাতার ছেলেগুলোও নাকি ফিরে এসেছে, অনুপ তো ফিরে এসে থেকেই তিনটে লেপের তলায়, একেবারে কাহিল হয়ে গেছে ছেলেটা। আমিই আসা বাকি ছিলাম। তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে অনুপকে দেখলাম। গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরোচ্ছে না, কুঁইকুঁই করছে। সেইভাবেই জানাল, ও ঠিক আছে, আজ রাতেই গ্যাংটক পৌঁছবে।

আমি বললাম, বস, পাগলামি কোরো না। গ্যাংটক ফেরার অবস্থায় তুমি একেবারেই নেই। হোটেল তোফা রয়েছে, এখানে আজ রাতটা থেকে যাও, আমি ওষুধ দিচ্ছি, কাল সকালের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে যাবে।

অনুপ তাও অ্যাডামেন্ট – যেতে ওকে হবেই, কাল ওকে জয়গাঁও পৌঁছতে হবে, পরশু ভুটানে এন্ট্রি নিতে হবে। শেষমেশ অনেক বোঝানোর পর সাব্যস্ত হল, ও আরও ঘন্টাদেড়েক বিশ্রাম করে বেরোবে, তবে গ্যাংটক নয় – মঙ্গনে আজ রাতটা থাকবে। কাল সকালে মঙ্গন থেকে সোজা জয়গাঁও চলে যাবে, এমন কিছু বাড়তি দূরত্ব হবে না। মঙ্গনে সেই সুনীলের ধাবায় রাত কাটানোর একটা বন্দোবস্ত নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।

অনুপ রাজি হল। ছিরিনকে ডেকে বললাম, ওকে এক প্যাকেট বিস্কিট দাও। আমার কাছে নরফ্লক্স গোটা পাতাটাই পড়ে ছিল, সেখান থেকে চারটে ট্যাবলেট ওকে দিয়ে বললাম, বিস্কিট খেয়ে একটা খেয়ে নাও, রাতের মধ্যে যদি বেটার না লাগে, তা হলে আরেকটা খেয়ে নেবে। কাল সকালে চাঙ্গা হয়ে যাবে।

চারটে বেজে গেছে। ছিরিন তাড়া লাগাচ্ছে লাঞ্চের জন্য, আজ চিকেন বানিয়েছে স্পেশালি। অনুপ তো খাবার অবস্থায় নেই, আমিই পেটপুরে চিকেন আর গরমাগরম ভাত খেলাম। সাথে আলুভাজা আর ডাল – আহা!

খেতে খেতে ছিরিন আর তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হল। ছিরিন এখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী, হোটেলটা স্ত্রীর নামে। স্ত্রী-র হাতের রান্না খুবই ভালো, তিনিই রান্নাটা দেখেন, আর ছিরিন হোটেল বিজনেসের বাকিটা দেখে। তখনই প্রথম ছিরিনের পুরো নামটা জানলাম।

খাওয়া শেষ, এবার বিল মেটানোর পালা। ছিরিন বিল আনল, চোদ্দশো টাকা। আমি তো অবাক! থাকার খরচাই আমার একার ছিল সাতশো টাকা – সেখানে দুজনের থাকা খাওয়া মিলিয়ে চোদ্দশো টাকায় হল কী করে?

ছিরিনই বুঝিয়ে দিল, রুম তো স্যার আপনারা ঐ একটাই নিয়েছেন, তাই রুমের কোনও এক্সট্রা চার্জ নেই। বাকি সাতশো শুধু কাল রাতের আর আজ দুপুরের খাওয়া আর সকালের ব্রেকফাস্ট। দুজনকার মিলিয়ে।

আমি জাস্ট মুগ্ধ। ছিরিন আমার লাগেজ বাইকে বাঁধতে পুরো সাহায্য করে দিল, কোথা থেকে অনুপের জন্য বিস্কিটের প্যাকেট এনে দিল। এবার যাবার সময়। নিচে অনুপের কাছ থেকে ফাইনালি বিদায় নিয়ে আবার ওপরে এলাম। অনুপের সাথে আর দেখা হবার নেই। বললাম, জয়গাঁও পৌঁছে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে জানিও।

ওপরে এসে ফাইনালি ছিরিনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দুহাতে জড়িয়ে না ধরে উপায় ছিল না। এই মানুষগুলোর সাথে দেখা হবার জন্যই তো রাস্তায় বেরোই, এমন সোনার মন, এতটা আতিথ্য, আশা করি নি। ছিরিনকে বললাম, লাচুং পৌঁছে ওকে খবর দেব।

সাড়ে পাঁচটায় স্টার্ট করলাম। এবার চুংথাং অবধি নিচে নামা – তার পরে ওপরে ওঠা। চুংথাং নেমে আসতে আসতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। পূর্বপ্রান্ত, তাই সন্ধ্যেও তাড়াতাড়ি হয়। এবার এগনো লাচুংয়ের দিকে। সোজাই রাস্তা। লাচুং হোমস্টে, যেখানে আমার বুকিং করা, সেখানে লোকটিকে একটু আগেই ফোন করে ডিরেকশন বুঝে নিয়েছি। লাচুংয়েরও একটা তোরণদ্বার আসবে, সেইখান থেকে দু কিলোমিটার আগে এগিয়ে ওকে ফোন করলেই ও চলে আসবে। তবে আমিও জিপিএসে সেট করে নিয়েছি ডেস্টিনেশন, অসুবিধে হবার কথা নয়।

চুংথাং থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটার বেশ খারাপ রাস্তা, তার পরে আবার রাস্তা ভালো হয়ে গেল। প্রায় আটটা নাগাদ হঠাৎ দেখি লোকবসতি শুরু হয়ে গেল, একটা দুটো হোটেল, দোকানপাট, সবকিছুতেই লাচুং লেখা। আমি কি লাচুং ঢুকে গেছি? তোরণ তো কই দেখতে পেলাম না? কী করব? লোকটাকে ফোন করব? নাকি জিপিএস ধরেই এগোব?

জিপিএস ধরেই এগোই। আরেকটু এগোতেই চোখে পড়ল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, লাচুং ব্র্যাঞ্চ। জিপিএস আরেকটু এগিয়ে ইঙ্গিত করল ডানদিকে টার্ন নিতে। সেখানে ঢুকে একটা জায়গায় এসে বলল, ইওর ডেস্টিনেশন ইজ অন দা লেফট। আমি এদিক তাকালাম, ওদিক তাকালাম, মাঝারি থেকে বড়মাপের বেশ কিছু হোটেল এদিক ওদিক, কিন্তু আমার সেই হোমস্টে কোথায়?

অগত্যা ফোন লাগাতে হল। সে ফোন তুলে বলে, তুমি কোথায়? এইবারে আমি পড়লাম মুশকিলে, আমি কোথায় সে তো আমি নিজেই জানি না – আমি বললাম, জাস্ট তিনশো মিটার আগে আমি একটা স্টেট ব্যাঙ্ক পেরিয়ে ডানদিক নিয়েছি। হোমস্টের লোকটা শুনে বলল, আরে আরে, তুমি তো পেরিয়ে এগিয়ে গেছো – ফিরে এসো। আমি – কোথায় ফিরব? লোকটা বলল – এক কাজ করো, স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে চলে এসো, আমিও আসছি ওখানে, তোমাকে রিসিভ করে নেব।

ফিরতে গিয়ে হল কেলো। স্টেট ব্যাঙ্ক কোন রাস্তায় যেন পেরিয়ে এসেছিলাম? খুঁজে পাচ্ছি না তো!

দাঁড়ালাম। দুটো লোক আসছে। হাত নেড়ে ডাকলাম – ভাই, স্টেট ব্যাঙ্ক কিধার পড়েগা?

লোকদুটো খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হল না – উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কেয়া কাম হ্যায়? আমি বললাম, কিসিকো আনা হ্যায় উধার, মিলনা হ্যায়, লোকদুটো শুনে আরও উলটো জবাব দিল – লেকিন স্টেট ব্যাঙ্ক তো আভি বনধ হ্যায়।

এ কি খিল্লি করছে নাকি আমার সাথে? আমি কি রাত্তির সাড়ে আটটার সময়ে টাকা জমা দেব বলে স্টেট ব্যাঙ্ক খুঁজছি? ধৈর্য ধরে বললাম, আমার ব্যাঙ্কে কাজ নেই, ব্যাঙ্কের সামনে একজন আসবে, তার সাথে দেখা করতে হবে, ব্যাঙ্কটা কোন রাস্তায় যাবো, বলে দাও –

নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সামনের দিকে হাত দেখিয়ে একজন বলল, আগে চলা জাও।

আমি আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম, এবং, যেখানটায় দাঁড়িয়ে আমরা এতক্ষণ কথা বলছিলাম, সেখান থেকে ঠিক পঞ্চাশ মিটার আগেই ছিল স্টেট ব্যাঙ্কটা। সেখানে দাঁড়াতেই একটা ছেলে এগিয়ে এল, অত্যন্ত সুদর্শন, কমবয়েসী একটা সিকিমিজ ছেলে – তুমি সিকি? দিল্লি থেকে? আমি ঘাড় নাড়তেই হাত বাড়িয়ে বলল, আমি সোনম, আমিই তোমার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম।

সোনম একটা মোটরসাইকেলে করে আমাকে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চলল তার বাড়িতে। স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে একটু পিছিয়ে একটা ঢালু রাস্তা, এদিক ওদিক সেদিক বেঁকে কীভাবে যেন আমাকে নিয়ে গিয়ে ফেলল ওদের বাড়িতে। লাদাখ হলে বলতাম, টিপিকাল লাদাখি বাড়ি, কিন্তু সিকিম, তাই এটা সিকিমের বাড়ি। একদিকের দেওয়াল বানানো টুকরো টুকরো কাঠ গুঁজে গুঁজে, বড় একটা উঠোন, সামনে আংটা থেকে ঝোলানো আছে এক কাঁদি ভুট্টা। মানে গুচ্ছখানেক ভুট্টা একসাথে বেঁধে ঝোলানো আছে – দেখে মনে হচ্ছিল কলার কাঁদির মত।

DSC_0191.jpgDSC_0195.jpg

চারখানা খাট পাশাপাশি রাখা একটা ঘর। বিশাল বড়। রাত নটা বাজে। ছিরিনকে ফোন করে দিলাম, বাড়িতে ফোন করলাম – এর পরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসা। প্রথমে সোনম আলাপ করিয়ে দিল ওর মায়ের সাথে, মিষ্টিমতন দেখতে সিকিমিজ বয়স্কা মহিলা, হিন্দি প্রায় বলতে পারেন না, সোনম বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। যেমন হয়ে থাকে, আমি কে, কোথা থেকে এরসেছি, বিয়ে করেছি কিনা ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর পেয়েই তিনি থামলেন, কারণ চা হয়ে গেছিল। বিশাল বড় একটা কাপে করে চা, আর সাথে ভুট্টাভাজা, চুল্লির সামনে বসে। পাশে একটা পেটমোটা বেড়াল। আহা, হামিনস্তো হামিনস্তো ব্যাপার।

সোনমের সাথে আলাপ হল। ছাব্বিশ বছরের যুবক, হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ দিয়ে দুবাইতে একটা বিশাল বড় হোটেলে চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু লাচুং ওকে টানছিল – তাই দুবাইকে বাই বাই করে ও চলে আসে এইখানে, এসে হোমস্টে-র বিজনেস খুলেছে।

কথা বলতে বলতেই রাতের খাবার এসে গেল। রুটি তরকারি ভাত ডাল আর ডিমের ঝোল। সোনম বলল, ডালটা শুধু মা বানিয়েছে – বাকি সমস্ত আমার নিজের বানানো।

মাইরি বলছি, আমি যদি মেয়ে হতাম বা সোনম যদি মেয়ে হত, তক্ষুনি প্রপোজ করে ফেলতাম। ফাটাফাটি হ্যান্ডসাম দেখতে, তার এমন সুন্দর রান্নার হাত – কী আর বলব।

খেতে খেতে পরের দিনের প্ল্যান হল। আমি সকালবেলায় বেরিয়ে ইয়ুমথাং আর জিরো পয়েন্ট ঘুরে দুপুর বেলাতেই ফিরে আসতে পারব, এমন কিছু দূরে নয়। আর এই সময়ে তো ইয়ুমথাংয়ে কিছুই দেখার নেই। মানে কোথাওই কিছু দেখার নেই, জাস্ট টাচ করে ফিরে আসা, ইয়ুমথাংয়ে ছোট বাজার বসে, ওখান থেকে কিছুমিছু কিনতে পারি। দুপুরে ফিরে এসে এখানেই লাঞ্চ সারব, তার পরে গ্যাংটকের দিকে ফেরত, সন্ধ্যের মধ্যে গ্যাংটক ফিরে আসতে পারব আরামসে।

সাড়ে দশটা বাজে। সকাল থেকে প্রচুর চলা হয়েছে, এইবারে ঘুমোতেই হবে। হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসছি, সোনম খুব কিন্তু কিন্তু স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল, ইয়ে, কালকে দুপুরের জন্য – তুমি, তুমি কি মুর্গী খাও?

আমার প্রশ্নটা বুঝতে তিরিশ সেকেন্ড মতন লাগল – তারপরে বললাম, সোনম, ধরে নাও আমি মুর্গীই খাই। আরও অনেক কিছুই খাই – কিন্তু চিকেন দিব্যি ভালোবেসে খাই। আর দুপুরে রুটি করতে হবে না, ভাতই খাবো তোমার রাঁধা চিকেনের ঝোল দিয়ে। … সোনম শুনে এত খুশি হল, কী বলব, মুখে প্রায় হাজার ওয়াটের এলইডি বাল্ব জ্বলে উঠল। বলল, কালকে তোমাকে আমার স্পেশাল চিকেন কারি বানিয়ে খাওয়াবো।

ঘুম ঘুম ঘুম। কাল বেশি ভোরে ওঠার গল্প নেই। সাতটায় উঠে সাড়ে আটটায় বেরোলেই চলবে।

WhatsApp Image 2017-11-08 at 19.50.23.jpg


1 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৭

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.