দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৬

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থপঞ্চম পর্বের পর

২৪শে অক্টোবর, পঞ্চম দিন

ভোর মানে, একদম ভোর। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল, তড়াক করে উঠে বসলাম। ব্যাগপত্তর কালকেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, এখন প্রথমে জিনিসগুলোকে দোতলা থেকে একতলায় নামাতে হবে, তার পরে পুল পেরিয়ে হুই মোটরসাইকেলের কাছ অবধি নিয়ে যেতে হবে। তিনটে ব্যাগ, একটা স্লিপিং ব্যাগ, একবারে তো সম্ভব হবে না। কাজের ছেলেটির সাহায্য করার কথা, কে জানে সে এখন কোথায়।

ছটার মধ্যে তৈরি হয়ে প্রথম প্রস্থের লাগেজ নিয়ে নিচে নামলাম। ছেলেটা নিচেই বসে ছিল আমার অপেক্ষায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপরে উঠে বাকি লাগেজ নামিয়ে আনল। তার পরে বের করল একটা খাতা। চেক আউটের সই, এবং দেড়শো টাকা। … টাকা কেন? আমি তো পেমেন্ট সমেত বুকিং করেছিলাম! দেখলাম, পাশে লেখা আছে, ডিনার। বোঝো! সেই রাতের সেই অখাদ্য – যা আমি প্রায় খেতে পারি নি, এমন আপ্যায়ন করে নিজের খাবার টেবিলে বসিয়ে খাওয়াল, তার দাম দেড়শো টাকা।

যাক গে, আর তো ফিরছি না এখানে। যা গেছে তা যাক! টাকাটা দিয়ে, অর্ধেক লাগেজ ছেলেটার হাতে দিয়ে পুল পেরিয়ে একবারেই সমস্ত সমেত পৌঁছে গেলাম মোটরসাইকেলের কাছে। বাঁধাছাঁদা সেরে স্টার্ট দিলাম গাড়িতে, এবং সওয়া সাতটার সময়ে পৌঁছে গেলাম গ্যাংটক মলের নিচে সেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসে, যেখানে দিনের বেসিসে পারমিট ইস্যু করা হয়। আগের দিনের পাওয়া চিঠির এক কপি দেখাতে হয়, সেইটা জমা নিয়ে ছোট্ট একটা স্লিপ কেটে দেওয়া হয় চালকের নাম, গাড়ির নম্বর ইত্যাদি বিবরণ সমেত, দশ টাকার বিনিময়ে।

আক্ষরিক অর্থে সাতসকাল, খুব বেশি ভিড় তাই ছিল না,মূলত লোকাল ক্যাব ড্রাইভারদেরই জমায়েত, তিন মিনিটের মধ্যে স্লিপ বা পর্ছি পেয়ে গেলাম। এইটারও গোটা আষ্টেক কপি করিয়ে রাখতে হয়, জায়গায় জায়গায় পুলিশ চেকপোস্টে এই স্লিপের কপি জমা দিতে হয়। কিন্তু, স্লিপে শুধুই নর্থ সিকিমের গন্তব্যের কথা লেখা কেন? গুরুদোংমার, ইয়ুমথাং, জিরো পয়েন্ট … ব্যস? আমার চিঠিতে তো ইস্ট সিকিমের গন্তব্যও লেখা ছিল! সেগুলো কেন নেই?

permit

কাউন্টারের ফাঁক দিয়ে আবার মাথা গলালাম। ওপ্রান্তে বসে থাকা পুলিশ অফিসার বুঝিয়ে দিলেন, এই চিঠি আর এই স্লিপের একটা করে কপি বাঁচিয়ে রাখো। নর্থ সিকিম সেরে যখন বার গ্যাংটকে ফিরবে, পরের দিন ইস্ট সিকিম শুরু করার আগে আবার সকালবেলায় এখানে এসে ওগুলো দেখাবে, আরেকটা স্লিপ বানিয়ে দেব ইস্ট সিকিমের জন্য। এক একটা স্লিপে এক এক দিকের পারমিটই দেওয়া হয়।

আচ্ছা, বোঝা গেল। আগের দিনই রেকি করে এসেছি – পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসের ঠিক পেছনেই একটি ফোটোকপি সেন্টার, যাকে পূর্বভারতের লোকেরা জেরক্স সেন্টার বলেন। সেখানে গিয়ে কপি টপি সব করে রাখলাম। ফিরে এসে দেখি কালকে দেখা সেই কেরালাইট ছেলেদের দল এসে গেছে। তিনজনের দল। আরও কিছু বাইকার ঘোরাঘুরি করছে, বেশির ভাগই বাঙালি। তাদের মধ্যে থেকেই একজন, অবাঙালি মত দেখতে একটা ছেলে – আমার হাতে পারমিটের কপির তাড়া দেখে আমাকে এসে ধরল, এখানে ফোটোকপি কোথায় হয়?

তাকে ডিরেকশন দিয়ে দিলাম। সৌজন্যমূলক আলাপ হল-টল, নাম অনুপ, বেঙ্গালুরু থেকে এসেছে। ওখানেই চাকরি, ওখানকারই ছেলে। একলাই এসেছে, যাবে নর্থ সিকিম, গুরুদোংমার দেখতে। … শুধু গুরুদোংমার? লাচুংএর দিকে যাবে না? ছেলেটা মিষ্টি করে হাসল, নাঃ, গুরুদোংমার দেখেই আমি যাবো ভুটানের দিকে। ওটা সেরে আবার লুরুতে ফেরত।

যাঃ, শুধু এই টুকুনি দেখার জন্য লুরু থেকে এলে? এলেই যখন, সব দেখে যেতে পারতে। যাক গে, একাই আছো তো?

অনুপ বলল, হ্যাঁ। তুমিও একা?

এঁজ্ঞে। আমি হাসলাম। চলো তা হলে, গুরুদোংমারটা দুজনে মিলে করে আসি, যদি তোমার আমার সঙ্গে চলতে আপত্তি না থাকে।

অনুপ লুফে নিল প্রস্তাবটা – না না, আপত্তি কেন, একসাথেই যাবো। তুমি তো দেখছি লাগেজ নিয়েই এসেছো, আমার সামনেই হোটেল – মোটরসাইকেলটা নিয়ে গিয়ে লাগেজ বেঁধে নিয়ে এখানেই আসছি, তুমি দাঁড়াবে একটু?

– হ্যাঁ-হ্যাঁ, কোনও অসুবিধে নেই। আজকের দূরত্ব তো খুব বেশি নয়, একশো কুড়ি কিলোমিটার মত।

– তোমার নাম্বারটা তা হলে দাও, আমি সেভ করে নিই। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই আসব, দরকার হলে কল করে নেব।

আমি নাম্বার বলছি, অনুপ মোবাইলে টাইপ করছে – করতে করতেই দেখছি, তার মুখ বদলে যাচ্ছে প্রচণ্ড বিস্ময়ে – তুৎ-তুমি … তুমি অচল সিকি? দিল্লিতে থাকো?

আমি তো হাঁ। মাইরি আমি কি ছেলেবিটি হয়ে গেলাম নাকি? লিখি তো বাংলায় – এ ব্যাটা কান্নাডিগা হয়ে আমার নাম জানল কেমন করে? – তুমি আমার নাম জানলে কী করে?

অনুপ তখন হা হা করে হাসছে, ডেস্টিনি, ডুড, ডেস্টিনি। মনে আছে, তোমার সঙ্গে আমার জুন মাসে এই ট্রিপ নিয়ে চ্যাট হয়েছিল? – এই দ্যাখো!

অনুপ আমাকে তার ফেসবুক মেসেঞ্জার খুলে দেখাল, সত্যিই তো আমিই! আমার সাথেই এর কথা হয়েছিল। অনুপ আমাকে দেখাল, হোয়াটসঅ্যাপেও আমার সাথে ওর বাক্যালাপ হয়েছিল বটে! – কেস হচ্ছে, জুন জুলাই নাগাদ যখন আমি প্ল্যান ফাইনালাইজ করছি, তখন বিসিএমট্যুরিং সাইট আর কয়েকটা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ট্র্যাভেল পার্টনার হবার জন্য। অনুপ তাদের মধ্যেই একজন। একে অপরের প্ল্যান শেয়ার করেছিলাম, কিন্তু ম্যাচ করে নি তাই আর কথা বাড়ে নি। যে হেতু একাধিক লোকের সাথে ঐ সময়ে কথা চালাচালি হয়েছিল, আমি আর তাই আলাদা করে কারুর নামই মনে রাখি নি। এখন দেখি গ্যাংটকে এসে আমাদের দেখা হয়ে গেল, আর কী আশ্চর্য, এতটা আসার পরে এমন একজনের সঙ্গে আগামী দুদিন কাটাতে চলেছি, যার সাথে আগেই আমার ভার্চুয়ালি আলাপ হয়েছিল।

ডেস্টিনি, সত্যিই ডেস্টিনি। নাম্বার আদানপ্রদান করে অনুপকে বললাম, তুমি লাগেজ বেঁধে নিয়ে এসো, আমি মনন ভবনের ঠিক সামনে দাঁড়াচ্ছি, এখানে দাঁড়ানোর জায়গা কম।

পাঁচশো মিটার দূরেই মনন ভবন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে মোবাইলে আরও একটা মেসেজ এল, হোয়াটসঅ্যাপে, কী ব্রাদার, স্টার্ট করেছিস, গ্যাংটক থেকে?

নীলাদ্রিদা আমার কলেজে তিন বছরের সিনিয়র। ছোটোখাটো গোলগাল চেহারা, ইঞ্জিনীয়ারিংএর থেকে কাব্যই বেশি মাথায় ঘুরত, তার ওপরে আমাদের কলেজের সেই মাথাঘোরানো সৌন্দর্য, হস্টেলের পেছনেই বিস্তীর্ণ চা-বাগান, তার মাঝখান দিয়ে ছুটে যাওয়া ডিব্রুগড় রাজধানী, এপাশ ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসা রুকরুকা নদী আর করলা নদীর ধারা, বিকেলবেলায় আকাশ লাল করা সূর্যাস্ত, আর আরেকটু দূরে চোখ মেললেই যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা সান্দাকফুর ঝকঝকে রেঞ্জ দেখা যেত, সেখানে বসে ইলেকট্রিকাল মেশিনের পড়াশোনাতে মন দেওয়া খুবই শক্ত কাজ ছিল, অন্তত নীলাদ্রিদার কাছে তো বটেই। কেরিয়ার প্রায় ডিরেল্‌ড হতে বসেছিল তার কবিতা লেখার আবেগে, কোনওরকমে সামলে সুমলে এখন সে কোর ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়েই রয়েছে। শিলিগুড়ির ছেলে, দীর্ঘদিন মণিপুরে ছিল, পরে এদিক ওদিক করে এখন সিকিমে একটা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্ল্যান্টে স্থিতু হয়েছে, গ্যাংটক থেকে সামান্য দূরে – ডিকচু বলে একটা জায়গায়। সেই নীলাদ্রিদার মেসেজ। কাল রাতেই মেল করে তাকে আমার ভুটানের ই-ভিসাটা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কথা হয়েছিল, নর্থ সিকিম সেরে যখন গ্যাংটকের দিকে ফিরব, দেখা করা যাবে, প্রিন্ট আউটও হস্তান্তর করে নেওয়া যাবে। ডিকচু যদিও আমার যাওয়া আসার রাস্তায় পড়ে না, তবে ডিকচুর অনতিদূরে একটা জায়গা আছে – মঙ্গন নাম। সেই মঙ্গন থেকে ডিকচু হয়েও গ্যাংটক আসা যায়, একটা অলটারনেট রুট আছে।

প্রসঙ্গত, কলেজে পড়াকালীন, আমার প্রথম গ্যাংটক আসাও নীলাদ্রিদার সাথেই।

নীলাদ্রিদাকে উত্তর দিতে দিতেই অনুপ এসে গেল, সাড়ে আটটায় আমরা চলা শুরু করলাম। সুন্দর রাস্তা, মাঝে একটু আধটু ভাঙাচোরা আছে, কিন্তু অসাধারণ সৌন্দর্য, টিপিকাল সিকিম। নীলচে সবুজ পাহাড়, হাতের নাগালে পাক খাচ্ছে ছাইরঙা মেঘ, কাছে গেলেই তারা কুয়াশা। ভিজে ভিজে ভাব, আবার পেরিয়ে গেলেই সূর্য। মাঝে মধ্যে দু একবার ফটো তোলার জন্যে দাঁড়ানো, আবার চলা।

DSC_0094DSC_0100DSC_0101DSC_0122DSC_013620171024_140901DSC_0118DSC_0121

সাড়ে দশটার মধ্যে একটা বড়সড় তিনমাথার মোড়ে এসে পৌঁছলাম। মঙ্গন। এখান থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা গেছে ডিকচু হয়ে -সেটা আগে গিয়ে আবার দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একটা গেছে গ্যাংটকের দিকে, অন্যটা শিলিগুড়ির দিকে, আর মঙ্গনের মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে আমাদের যেতে হবে চুংথাং হয়ে লাচেন।

সকাল থেকে খাওয়া হয় নি কিছু, মঙ্গনে বড় বড় বেশ কয়েকটা ধাবা টাইপের ফুড জয়েন্ট। আমরা প্রথমটাতেই ঢুকলাম। মালিকটি মোটামুটি মনে হল আমাদেরই বয়েসী, খুব হাসিখুশি। দেখে অবশ্য সিকিমের লোক বলে মনে হল না। কী পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করাতে বলল, আলু পরাঠা খান। গরমাগরম বানানো হচ্ছে। সঙ্গে কফি দিই?

তাই দিন। বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে গেল আলু পরোটা। পেছনের দিকের টেবিলে কয়েকজন বিদেশী ছেলে গল্প করছে, ওরাও বাইকার, এখানে এসে বুলেট ভাড়া করেছে। মালিক ছেলেটাকে তাদের একজন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছিল, এখানে বাইক রিপেয়ারিং শপ কোথায় আছে। উত্তরে মালিক স্পষ্ট এবং নির্ভুল ইংরেজিতে তাদের বলল, এমনিতে তো এখানে কিছু নেই, তবে ডিকচুতে গেলে একটা রিপেয়ারিং শপ পাওয়া যেতে পারে। সেখানে না হলে গ্যাংটকের আগে কোনও উপায় নেই।

কার বাইকে কী সমস্যা হয়েছে জানি না – কিন্তু প্রথমে মালিক লোকটির হিন্দি, তার পরে ইংরেজি শুনে কেমন চমকিত হয়ে গেলাম। এত পলিশড! ঠিক ধাবাওয়ালা বলে তো মনে হচ্ছে না! আরও চমকিত হয়ে গেলাম আলু পরোটা মুখে দিয়ে। একটা করে অর্ডার করেছিলাম, শেষমেশ দুজনেই চারটে চারটে করে আলু পরোটা খেয়ে ফেললাম গরম কফির সাথে।

খেয়ে নিয়ে আলাপ জুড়লাম লোকটার সাথে। আপনি সিকিমের লোক তো না – কোথায় বাড়ি?

লোকটি আমাকে চমকে দিয়ে বলল, দিল্লি।

কী সাংঘাতিক! দিল্লির কোথায়?

দিল্লির যে জায়গার নাম বলল, আমার তার ঠিক দুটো সেক্টর পাশেই বাড়ি, একই এলাকায়, খুব বেশি হলে তিন কিলোমিটারের দূরত্বে। … তা, দিল্লি ছেড়ে এখানে? নাম কী আপনার?

সুনীল। সুনীল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে অনেকদিন কাজ করেছে আইবিএমে। গুরগাঁও আইবিএম – সিলোখেরা অফিসে। প্রথমে টেকনিকাল, পরে প্রজেক্ট ম্যানেজার। ওখানে এক সময়ে আমিও কাজ করতাম। তিন বছর আগে সুনীল সিকিম ঘুরতে আসে। প্রথম দেখাতেই এত ভালোবেসে ফেলে জায়গাটাকে, ফাইনালি দু হাজার সতেরোর গোড়াতেই সিকিমের স্থানীয় এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে এই ফুড জয়েন্টটা খুলে ফেলে, আইবিএমের চাকরি ছেড়ে।

20171024_102736

– পোষাচ্ছিল না, বুঝলেন। কর্পোরেট জগতটা শালা এত বেশি হারামিতে ভর্তি, চোখের সামনে ম্যানেজারের খচরামির জন্য দুরন্ত টেকনিকাল জনতাকে একের পর এক কম্পানি বদলাতে দেখেছি, ভেবেছিলাম আমি অন্য রকমের ম্যানেজার হব, কিন্তু কর্পোরেট কালচার শালা বিষ মাল, আমাকেও ওই রকমের খচ্চর হবার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছিল। সহ্য করা একেক সময়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। সিকিম আমাকে মুক্তি দিয়েছে। আমি খুশি, খুব খুশি। যা কামাতাম, তার থেকে সামান্য কম কামাই এখানে, কিন্তু এ তো আর দিল্লি নয়, যা রোজগার হয় তাই দিয়ে আমার দিব্যি চলে যায়। ভালো সেভিংস হয়। জানুয়ারিতে এসেছিলাম, আর দিল্লি যাই নি, দেখি, আসছে জানুয়ারিতে হয় তো যাবো একবার।

আমি হাঁ করে শুনছিলাম। প্রপার দিল্লিতে বড় হওয়া একজন ছেলে, অথচ “দিল্লির মাইন্ডসেট” বলতে আমরা যা বুঝি, তার থেকে কতটা আলাদা! এ যেন হুবহু আমার মনের কথাগুলো বলে গেল – শুধু আমি হয় তো কোনও দিন সাহস করতে পারব না সব ছেড়ে এ রকম পাহাড়ে এসে নিজের বিজনেস চালাবার। সুনীলের চোস্ত হিন্দি আর ইংরেজি বলার রহস্য এইবারে আমার কাছে পরিষ্কার হল, আর পরিষ্কার হল আলু পরোটার টেস্ট এমন দিল্লি-দিল্লি টাইপের উমদা কেন। সুনীলের প্যাশন রান্না করা, এখানে একজন কুক রেখেছে, তবে ভিড় বাড়লে নিজেও রান্না করে। আর সেইজন্যেই গ্যাংটক থেকে ছেষট্টি কিলোমিটার দূরে এই মঙ্গনেও একদম দিল্লির স্বাদে আলু পরোটা পাওয়া যায়।

সুনীলকে বললাম, কোনওদিন যদি এই জার্নি নিয়ে লিখি, তো তোমার কথা নিশ্চয়ই লিখব। … আজ কথা রাখা হল সুনীলের কাছে। আপনারা এর পরে যখন গুরুদোংমারের দিকে যাবেন, মঙ্গনের মোড়েই স্পট করতে পারবেন চিরাগ দা ধাবা-কে। অবশ্যই ওখানে আলু পরোটা খেয়ে যাবেন।

DSC_0141

সুনীলের সাথে অতক্ষণ কথা বলতে দেখে বিদেশী ছেলেদের দলের একজন এগিয়ে এসে আলাপ করল। ইউক্রেন থেকে এসেছে, পাঁচ বন্ধু। গুরুদোংমার সেরে কালকেই ফিরেছে, এই ধাবাতেই কাল রাতে থেকেছে। রাস্তা নাকি এত খারাপ, এত খারাপ – একজনকার বুলেটের সাইলেন্সার-এক্সহস্ট ঝাঁকুনির চোটে ভেঙে বেরিয়ে গেছে। এমনিতে গাড়ি চালাতে তার জন্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে না – কিন্তু সাইলেন্সারটা ওয়েল্ডিং করে আবার লাগানোটা জরুরি। কতটা খারাপ রাস্তা, কে জানে! আমার লাদাখে দীর্ঘ দেড়শো কিলোমিটার অফরোডিং করা আছে, আর এই সেদিন স্পিতি ঘুরে এসেছি ভয়ঙ্কর খারাপ রাস্তা দিয়ে, তার থেকেও কি খারাপ হবে? মনে হয় না।

প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওখানে সময় কাটিয়ে আবার এগোলাম। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, আর সামান্যই বাকি আছে আজকের জন্য। অনুপকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি লাচেনে হোটেল বুক করে রেখেছো? অনুপ বলল, ধুর – ওখানে গিয়ে দেখে নেব। আমি বললাম, তা হলে আমার সাথেই থেকে যাও – আমার তো বুকিং করা আছে, যদি রুম খালি থাকে তুমিও একটা রুম ওখানেই নিয়ে নিও। কাল ভোর ভোর একসাথেই বেরোব।

বাকি রাস্তাটা মোটামুটি একই রকম, দুটো সওয়া দুটো নাগাদ চুংথাংএ পৌঁছলাম। ছোট্ট একটা জনপদ, গুটিকয় বাড়ি, একটা বিশাল গুরুদ্বারা, একটা হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার স্টেশন আর সামান্য আর্মি এসট্যাবলিশমেন্ট। চুংথাংএর মোড়টা খুবই প্রমিনেন্ট, সোজা রাস্তা চলে যাচ্ছে লাচুংএর দিকে, আমরা নিলাম বাঁদিকের রাস্তা, লাচেন।

DSC_0154

তিনটে নাগাদ লাচেনের গেট পেলাম। একটা তিব্বতী স্টাইলে বানানো তোরণদ্বার মত, পাহাড়ের সব ছোটবড় টাউনেই এই রকমের ওয়েলকাম টু … লেখা তোরণদ্বার থাকে। সেইখানে ফাইনাল চেকপোস্ট, চিঠি এক কপি জমা করতে হয়। জমা নিয়ে অফিসার বললেন – সঙ্গে প্লাস্টিক পলিথিন কিছু আছে?

মানে, সে তো আছেই – আমার জেরিক্যান পলিমার প্লাস্টিকের, সঙ্গে জলের বোতল আছে, সেটা ডিসপোজেবল নয় যদিও – বের করে দেখালাম। উনি দেখে বললেন, না – ঠিক আছে, এগুলো অ্যালাওড। কিন্তু ডিসপোজেবল প্লাস্টিক কিছু থাকলে এখানেই ফেলে যান। পরে যদি লাচেন বা তার পরের কোনও ডেস্টিনেশনে প্লাস্টিক ফেলতে গিয়ে ধরা পড়েন, দশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে জেলেও ঢুকতে হতে পারে। খুব সাবধান।

অনুপের কাছে একটা বিসলেরির বোতল ছিল – ডিসপোজেবল। সেটাকে খালি করে ওখানেই ক্যানে ফেলে দিয়ে আমরা এগোলাম।

লাচেন ছোট্ট একটা টাউন। ঢুকতেই লাচেনের মার্কেট, মার্কেট মানে কয়েকটা দোকান মাত্র – সেগুলো পেরোতেই ডানহাতে আমাদের হোটেল পেয়ে গেলাম – মাউন্টভিউ রেসিডেন্সি। নাম বলতেই খুদে খুদে চোখদুটোকে একমুখ হাসিতে পুরো ঢেকে দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন মালিক, ছিরিন থোপদেন ভুটিয়া। আমি বললাম, বুকিং তো আমারই ছিল, কিন্তু এ (অনুপকে দেখিয়ে) আমার সঙ্গে এসেছে – এর জন্যেও একটা ঘর দরকার।

ছিরিন বলল, কোনও অসুবিধে নেই, আপনার জন্য ডবল বেডরুমই রেখেছি, দেখে নিন, যদি দুজনে থাকতে না পারেন, আমি অন্য ঘর খুলে দেব। ঘর খালি আছে।

খুব ভালো কথা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম নিচে। পাহাড়ি রাস্তার ধারে বিল্ডিং যে রকম হয় – রাস্তার লেভেলে এন্ট্রান্স, বাকি বাড়িটা পাহাড়ের নিচের দিকে। একটু এগিয়ে ঘুরে ব্যালকনির দিকে যেতেই বিস্ময়ে আমার দু চোখ ভরে গেল।

20171025_053209

সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সামনের বিস্তীর্ণ দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে খেলে যাচ্ছে নীলচে মেঘ, আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গলের শিল্যুয়েট, আর সেই জঙ্গলের বুক চিরে দূরে বয়ে চলেছে একটা সাদা সুতোর মত নদী, কিংবা ঝোরা। সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য, বলে বোঝানো যাবে না। … সন্ধে হয়ে আসছে, খুব বেশিক্ষণ আলো থাকবে না, তাই তাড়াতাড়ি লাগেজ ঘরে ঢুকিয়ে আমি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এলাম আবার ব্যালকনিতে। বেশ সুন্দর ঠাণ্ডা – তিন চার ডিগ্রি মত হবে, সেই এক সময়ে আমাদের দিল্লিতে ডিসেম্বরের শেষদিকে যে রকম ঠাণ্ডা পড়ত, হাত ঠাণ্ডা করে দেওয়া, কিন্তু দারুণ আরামদায়ক।

DSC_0162

ব্যালকনির ঠিক নিচেই এক চিলতে জমি, সেইখানে ফলেছে ইয়া বড় বড় সাইজের বাঁধাকপি আর শালগম। ছিরিন কফি নিয়ে এসেছিল, তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এ তার নিজের হাতে ফলানো ফসল। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে ফলানো – কোনও কেমিকাল ইউজ হয় না। পুরো সিকিম জুড়ে কেমিকাল সার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কেউ কেমিকাল ইউজ করলে তাকে সরকারের তরফ থেকে শাস্তি দেওয়া হয়, চাষ করার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। পুরো রাজ্যটা অর্গানিক পদ্ধতিতে সমস্ত ফসল ফলায়।

এদিকে অনুপের অবস্থা রীতিমত খারাপ। সে এই ঠাণ্ডায় রীতিমত কাবু। তিন চার ডিগ্রি সহ্য করার অভ্যেস তার নেই – সে কখনওই এত ঠাণ্ডা নাকি এর আগে দেখে নি। অতএব, ঘরে ঢুকে প্রথমেই লেপ চাপিয়ে নিয়েছে নিজের ধরাচূড়ো না ছেড়েই, তাতেও তার ঠাণ্ডা কমছে না, ছিরিনের কাছে তার দাবি পেশ হল, একটা রুম হীটার এনে দাও। ছিরিন খুব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, রুম হীটার ব্যবহার করা এখানে নিষিদ্ধ, ধরা পড়লে আমার হোটেলের লাইসেন্স চলে যাবে। আমি আপনাকে আরেকটা ব্ল্যাঙ্কেট এনে দিচ্ছি। আপনারা কি কিছু খাবেন?

সকালের আলু পরোটা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, দুপুরে লাঞ্চ হয় নি, বললাম, খাবো। লাঞ্চ হোক বা ডিনার, ভরপেট খাবারের ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ – আর – কী বললে, এখানে এই ঠাণ্ডায় রুম হীটার কেন নিষিদ্ধ?

ছিরিন জানাল, লাচেনে সমস্ত সাপ্লাইই আসে মঙ্গন থেকে, তার আগে কিছু নেই। আর ইলেকট্রিসিটি আসে চুংথাংএর হাইডেল প্ল্যান্ট থেকে, প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ইলেকট্রিসিটি। কেউ যদি রুম হীটার ইউজ করে, তাতে কানেকশন ট্রিপ করে গেলে সমস্যা তো শুধু একার নয়, পুরো লাচেন এলাকার সবার ইলেকট্রিক কানেকশন চলে যাবে। আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বিজলি অফিসের লোকজনের পক্ষে সবসময়ে সারাতে আসা সম্ভব না-ও হতে পারে, বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তো চিত্তির, যতক্ষণ না কেউ আসছে, পুরো গ্রামটাকে অন্ধকারে কাটাতে হবে। এই কারণেই রুম হীটার নিষিদ্ধ, এই কারণেই ফাইন বা অন্যান্য শাস্তি।

সাতটার সময়ে খাবারের ডাক এল ওপর থেকে। সদ্য হাঁড়ি থেকে নামানো ভাত, ফুটন্ত ডাল, পাঁপড়, আলুভাজা আর গরমাগরম অমলেট। আহা, অমৃত, অমৃত। ছিরিন জানাল, চিকেনের সাপ্লাইও এখানে আসে মঙ্গন থেকে, আজ তো আর হল না, কাল দুপুরে গুরুদোংমার ঘুরে আসার পরে আমাদের গরম গরম চিকেনের ঝোল আর ভাত খাওয়াবে।

আহা, ছিরিন পুউরো দেবদূত। অমন চমৎকার ঠাণ্ডায়, একটাআস্ত ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে কোনও রকমে একটা হাত বের করে অনুপ ডিনার সারল – আমি খেয়ে উঠে একটু হাঁটতে বেরোলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ, অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে।

খানিক বাদে ঘরে ফিরে এসে দেখি পাশের বিছানায় লেপের একটা স্তুপ হয়ে আছে, তার ভেতর থেকে কন্নড় ভাষায় কিছু কথাবার্তা ভেসে আসছে। অনুপ, কাউকে ফোন করছে।

ফোন টোন সেরে, খানিক গল্পগুজব হল। ছিরিন আবার এসে একটা ব্যাটারি ল্যাম্প দিয়ে গেল – জানিয়ে গেল সকাল সাড়ে পাঁচটার সময়ে এখান থেকে স্টার্ট করতে হবে, ও পাঁচটার সময়ে ঘরে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়ে যাবে। জেলি, ব্রেড, অমলেট, চা।

কাল তা হলে গুরুদোংমার হচ্ছে। লাগেজ এখানেই রেখে যাবো, ফিরতি পথে লাঞ্চ সেরে, লাগেজ নিয়ে লাচুং চলে যাবো, অনুপ ফিরে যাবে গ্যাংটকের দিকে।

জয় গুরু। দোংমার।

 


1 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৬

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.