জলু – দ্বিতীয় পর্ব

সবেমাত্র রুম খুঁজে হোল্ডঅল খুলে তোষক বের করে পেতেছি টিনের খাটে, আবিষ্কার করেছি তাতে বসলে উঠলে ঘটাং ঘটাং করে বিকট শব্দ হয়, তখন বেলা দশটা, হস্টেল মোটামুটি ফাঁকা, সবাই কলেজে, কেবল ফার্স্ট ইয়ারের সদ্য ইনটেক নেওয়া ছেলেরা রয়েছে, আমাদের ক্লাস তখনও শুরু হয় নি। হ্যাঁ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে অ্যাডমিশন হয় না, হয় ‘ইনটেক’। ছোট ঘর, রুমমেট তিনজন, আমাকে নিয়ে চার, তাদের সাথে আলাপ করলাম। আমার খাট জানলার ধারে, করিডরের দিকের জানলা, সেই জানলা ভর্তি হয়ে আছে অজস্র অচেনা মুখে, আর প্রায় চেঁচামেচির পর্যায়ে চলে যাওয়া একটা সম্মিলিত ফিসফাস, ‘ছানা এস্‌চে, নতুন ছানা এস্‌চে’। খাটের ওপর সব শুনেও কিছুই শুনতে পাচ্ছি না এবং কিছুই-বুঝতে-পারছি-না (এটা সত্যিই, আমাকে ছানা বলছে এটুকু বুঝছিলাম, কিন্তু ছানা কেন বলছে সেইটা বুঝি নি) মত মুখ করে বসে আছি আমি আর বাবা। বাবা ট্রাঙ্কের চাবি আমার পৈতেয় বেঁধে দিয়েছে (তখনও পৈতে পরতাম), ঘরের লকারে আমার জায়গা মিলে গেছে, এমন সময়ে … … More জলু – দ্বিতীয় পর্ব

জলু – প্রথম পর্ব

নিজের জীবনে পরে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, কিছু জিতেছি, কিছু হেরেছি, কিছু লড়াই এখনও চলছে, কিন্তু সে ছিল আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ জেতা। ইলেভেনে ফেল, হেডুর দয়ায় টুয়েলভে ওঠা, বাংলার কোচিংএ যে মেয়েটিকে দেখে হাবুডুবু খেতাম, তাকে একদিন সাহস ভরে তুতলেমুতলে প্রোপোজ করতে গিয়ে জোরদার প্রত্যাখ্যান পাওয়া, অঙ্ক ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির কোচিংয়ে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে আবিষ্কার করা অন্যদের থেকে আমি কতটা পিছিয়ে আছি, দিন রাত এক হয়ে যাচ্ছে পড়ার ব্যাকলগ ক্লিয়ার করতে, তার মধ্যে হাতে আসছে আনা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি, তার মধ্যে ঠিক সময় করে বন্ধুদের সাথে হ্যাহ্যাহিহি করাও চলছে, আর মাথার মধ্যে সমানে ঘুরছে – সত্যসাধনবাবু একঘর বন্ধুবান্ধবীর সামনে আমাকে বলেছিলেন, তুমি অমিতাভ মিত্র দেখে কী করবে, জয়েন্ট ফয়েন্ট তোমার দ্বারা … আর আমি পড়ার মাঝে কেবল বিড়বিড় করছি, আমি পেয়ে দেখাব আপনাকে স্যার, আমি ঠিক পেয়ে দেখাব।  … More জলু – প্রথম পর্ব

ইতিহাস পড়ার প্রক্রিয়া – শ্রীমতি রোমিলা থাপার

জেমস মিল ভারতের প্রথম আধুনিক ইতিহাসের রচয়িতা। দ্য হিস্টরি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ১৮১৭ সালে প্রকাশিত। তিনি লিখতে শুরু করেন ১৮১৭ সালে, এবং লেখা চালিয়ে গেছিলেন পরবর্তী ৩-৪ বছর ধরে। এর বেশির ভাগই ছিল ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত, যা তিনি নিজেই ঠিক বলে মনে করতেন। মিল দাবি করেছিলেন যে, ভারতের ইতিহাস আসলে দুটি জাতির ইতিহাস, হিন্দু এবং মুসলিম, যা খুব স্পষ্টভাবে পৃথক এবং ক্রমাগত পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে গেছে। ভারতীয় ইতিহাসকে এইভাবে বিভক্ত করা হয়েছে; সর্বপ্রথমে ছিল হিন্দু যুগ যেখানে হিন্দুধর্ম বেশি প্রভাবশালী ছিল, তারপরের যুগে আসে ইসলামী শাসকের আধিপত্য। এবং সবশেষে আসে ব্রিটিশ যুগ যারা এই তৃতীয় যুগের নিয়ন্তা। এই যুগবিভাগ ভারতীয় ইতিহাসকে গভীরভাবে আলাদা আলাদা রঙে চিত্রিত করেছিল। যদিও আজকের দিনের পেশাদার ইতিহাসবিদরা মিলের এই তত্ত্বকে খারিজ করেছেন এই বলে, যে প্রতিটা যুগের ঐতিহাসিক ক্রিয়াকলাপকে কেবলমাত্র সার্বিকভাবে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করার ব্যাখ্যা আদপেই গ্রহণযোগ্য নয়, তবু এখনও, পেশাদার ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচিতি পাবার অযোগ্যরা মিলের ব্যাখ্যা ব্যবহার করে চলেছেন। … More ইতিহাস পড়ার প্রক্রিয়া – শ্রীমতি রোমিলা থাপার

বাবরি মসজিদ, আর এক বন্ধুকে হারানোর গল্প

সেদিন বিকেলেই, আমি শুনতে পেলাম সরতাজ আনসারি আর আব্বা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে আলোচনা করছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত জেলা আধিকারিকদের যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। খবর আসছিল, মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে মুসলিম গ্রুপগুলো জোর করে দোকানদারদের দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করছিল, অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী হিন্দু গ্রুপগুলো মিষ্টি বিলিয়ে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করছিল।  ‘এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু যে কোনও সময়ে তা খারাপ হতে পারে। হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে পারে, কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে মন্দির ভাঙচুরের খবর আসছে,’ সরতাজ আনসারি বললেন। … More বাবরি মসজিদ, আর এক বন্ধুকে হারানোর গল্প

রাহুল গান্ধী (এবং ভারত জোড়ো যাত্রা)

পাপ্পু। এই নামেই দীর্ঘদিন ধরে তাকে হ্যাটা করা হয়েছে। সংসদের ভেতরে, বাইরে। পলিটিকাল অ্যানালিস্টরা রাহুলের ব্যক্তিত্বে কংগ্রেসকে পুনজ্জীবিত করে তোলার কোনও ক্ষমতা, কোনও আশা দেখতে পান নি। রিলাকট্যান্ট পলিটিশিয়ান। শরীরে অর্ধেক ইটালিয়ান রক্ত, দলের সদস্য, দলের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও যখন খেয়াল ওঠে, উনি ভ্যাকেশনে চলে যান। একাধিকবার কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, পরে আবারও ফিরে বসতে হয়েছে সেই সিংহাসনেই। রাহুলকে সভাপতি রেখে দলের কোনও উন্নতি তো হয়ই নি, বরং পরের পর ভরাডুবি ঘটেছে, অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকাশ্যে এসেছে। কেউ দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তো কেউ নিজের পার্টি খোলার চেষ্টা করেছেন। বাকিরা, শতাব্দীপ্রাচীন, এই বনেদী জমিদারীর লিগ্যাসী বয়ে চলা, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার রাজনৈতিক দলটির অনুগত সেবক হয়ে হাত জোড় করে নাক খত দিয়ে সনিয়া গান্ধী রাহুল গান্ধীরই নিঃশর্ত আনুগত্য ঘোষণা করে গেছেন। এত ভাঙন দেখে, এককালের অনেক সমর্থকই হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন, এবং ঘর সামলাতে ব্যর্থ রাহুলকে মজা করে তারাও ‘পাপ্পু’ বলেই ডেকেছেন। … More রাহুল গান্ধী (এবং ভারত জোড়ো যাত্রা)

জেলখানার চিঠি

অবশ্য আজকাল কে-ই বা তথ্য, সত্য – এসব নিয়ে মাথা ঘামায়? আজকের ভারতে সত্য সেটাই যা মানুষের কাছে পৌঁছয়, যা আসলে ঘটেছিল সেটা নয়। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলি, আমার কথা বা আচরণের চেয়ে তাদের অনেক বেশি প্রভাবিত করে ওইসব শিরোনাম। দুবছর ধরে আমি দেখছি, মানুষ ছাপা শব্দের উপর প্রায় নির্বোধের মত বিশ্বাস করে। আপনি যাকে “নিজের চোখে দেখা প্রমাণ” বলেন, তার উপরেও মানুষের অত বিশ্বাস নেই। লোকে ভাবে কাগজে যখন বেরিয়েছে তখন অমুক কথাটা নির্ঘাত সত্যি। “কিছু তো নিশ্চয়ই করেছে। কাগজে কি আর পুরোপুরি মিথ্যে লিখবে?” … More জেলখানার চিঠি

নানা দেশের গল্প

মা নেই। বাবা বুড়ো মানুষ, গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। দাদা থাকে কলম্বোর কাছে। তার চাকরি সেখানে – যদিও কতদিন সে চাকরি থাকবে, কেউ জানে না। দাদা বাবাকে দেখতে যেতে পারছে না – কেন? দাদার কাজের জায়গা তাদের গ্রাম থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে। পেট্রলের দাম, পেট্রল পাম্পে সাড়ে সাতশো টাকা (সেদিনের রেট, আজ হয় তো আরও অনেক বেশি) প্রতি লিটার। তাও সে পেট্রল পাওয়া যাচ্ছে তিন থেকে পাঁচ দিন লাইনে অপেক্ষা করে। শুরু হয়েছে ব্ল্যাকমার্কেটিং। ব্ল্যাকে পেট্রল বিক্রি হচ্ছে দু হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা প্রতি লিটারে। … More নানা দেশের গল্প

১৯শে জানুয়ারি, ১৯৯০ঃ ঠিক কী হয়েছিল?

সেই রাতে টিভিতে রোমানিয়ার বিপ্লব দেখানো হচ্ছিল। মাত্র এক মাস আগে বার্লিনের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে কিছুদিন আগে, সেই সংক্রান্ত অশান্তি, বিশেষত আজারবাইজানের গণ্ডগোল সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল দূরদর্শনে। (জগমোহন মনে করতেন, এমনিতে প্রায়-অচল দূরদর্শনের পক্ষে সেই রাতে এইসব বিপ্লবের ভিডিও ব্রডকাস্ট করা একেবারে উচিত হয় নি – শ্রীনগরের লোকের হয় তো মনে হয়েছিল দুনিয়া বদলে যাচ্ছে, তাদের দুনিয়াও এইভাবেই বদলে যাবে।)

বহু লোকের স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সন্ধ্যা, সারা রাত জুড়ে মসজিদের লাউডস্পিকার থেকে শ্লোগান দেওয়া হচ্ছিল, রাস্তায় মানুষজন শ্লোগান দিচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে একটি শ্লোগান ছিল – “জাগো জাগো সুবহ হুয়ি; রুশ নে বাজি হারি হ্যায়, হিন্দ পর লারজান তারে হ্যায়, অব কাশ্মীর কি বারি হ্যায়”। … More ১৯শে জানুয়ারি, ১৯৯০ঃ ঠিক কী হয়েছিল?

জলু – দশম (শেষ) পর্ব

ক্লাস টুয়েলভে ওঠার মুখে সেই যে কমলা সালোয়ার কামিজ আর ঘিয়ে রঙের সোয়েটার পরা মেয়েটির মুখে রূঢ় ‘না’ শুনে আমার প্রথম প্রেমের সম্ভাবনা ভেঙে গেছিল, তার পরে দীর্ঘদিন আর সে রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করি নি। কলেজেপ্রেম হবার পরিবেশ ছিল না, সে রকম কাউকে মনেও ধরে নি। চিঠি লিখতাম আমার সেই ইলেভেল টুয়েলভের টিউশনের বন্ধু বান্ধবীদের। চিঠির উত্তরের সংখ্যা কমতে কমতে ক্রমশ ঠেকেছিল দুটিতে। দুজনেই বান্ধবী। তাদের একজনের ছায়া আমার মনের ওপর পড়তে লাগল ধীরে ধীরে। হুগলি-কলকাতায় গেলেই তার সাথে দেখা করতাম, মনে মনে তাকে চাইতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু মুখ ফুটে আর বলার সাহস ছিল না, প্রথম প্রত্যাখ্যানের ঘা তখনো মোছে নি। যদিও এখন আমি ফোর্থ ইয়ার, এখন আমার বাইশ বছর বয়েস, পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি সতেরো বছর বয়েসে সে অনুভূতি প্রেম ছিল না, নিতান্তই ভালোলাগা, আগুপিছু কিছু না ভেবে ভালো লেগে যাওয়া, মুখের ওপর ‘না’ বলে আসলে আমার উপকারই করেছিল মেয়েটি, কিন্তু এবার যখন বুঝতে শুরু করলাম, আমার নতুন অনুভূতি, আর কিছু নয়, সত্যিকারের ভালোবাসা, তখন আর দ্বিতীয়বারের জন্য সাহস ফিরে পেলাম না। এক তো আগের অভিজ্ঞতা, আর দ্বিতীয়, আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কোন মুখে তাকে বলব, আমি ভালোবাসি? … More জলু – দশম (শেষ) পর্ব

জলু – নবম পর্ব

না, গণ্ডার দেখা হয় নি সে-যাত্রা, কিন্তু যা দেখেছিলাম, তার সৌন্দর্য কোনও অংশে কম নয়। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাতির পিঠে চেপে চলেছি, মাঝে মাঝেই বাচ্চা শুঁড় দিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরছে, দুধ খাচ্ছে মায়ের, সামান্য বিরতির পর আবার চলা, ভিজে শাল সেগুনের পাতা আমাদের গায়ে বুলিয়ে যাচ্ছে চলার পথে, আমরা ভিজে যাচ্ছি ভোরের শিশিরে, হঠাৎ করে চারদিক আলো করে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল ইয়াব্বড় একটা টকটকে লাল রঙের সূর্য। সে সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যতটা পারছি, শুষে নিচ্ছি সে রূপ, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। … More জলু – নবম পর্ব

জলু – অষ্টম পর্ব

কে কীভাবে খবর দিয়েছিল জানি না, তবে তার পরের ঘটনাগুলো ম্যাজিকের মত ঘটল। সুব্বা ফোর্থ ডান ব্ল্যাক বেল্ট। বেসবল ব্যাট মটকে ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রাখে। অতএব, দেড়শো ছেলে একসাথে নেমে এল নিচে, প্রথমে হস্টেলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে তালা মারা হল। তারপর ম্যাজিকের মত সকলের হাতে চলে এল অস্ত্র। জিনিসগুলো এক্স্যাক্টলি আমাদের ঘরেই ছিল, কেউ জানতাম না, কী করে যে সেই মুহূর্তেই জেনে ফেললাম তাও মনে পড়ছে না, কেবল মনে আছে আমার ঘরেই লকারের মাথা থেকে বেরোল একটা হকিস্টিক, একটা চেন। আমি হকিস্টিকটা নিলাম, আমার রুমমেট কেকে নিল চেন। কীভাবে ওগুলো চালাতে হয়, প্রায় কেউই জানত না, আমি তো জানতামই না, কিন্তু হাতে ওগুলো থাকলে কনফিডেন্স বাড়ে। প্রায় পুরো হস্টেল এই রকম চেন রড হকিস্টিক ইত্যাদি জিনিস নিয়ে নিচে মেন গেটের সামনে লবিতে পজিশন নিল, কেবল মাত্র একজন ফোর্থ ডান ব্ল্যাক বেল্টের মোকাবিলা করার জন্য। … More জলু – অষ্টম পর্ব

জলু – সপ্তম পর্ব

এই বার একটু ভয় করতে শুরু করল, ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসার, না জানি কি জাঁদরেল লোক হবেন টবেন। ধমকেই যদি ভির্মি খেয়ে যাই, তা হলে বার্গেইন করব কী করে? আমরাই উদ্যোগী হয়ে গঞ্জ খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম, পেয়েও গেলাম একটু হাঁটতেই, ছোট্ট গ্রামের মধ্যেই আরও ছোট্ট একটা চত্বরে গুটিকয় দোকান, তার নাম গঞ্জ। বোদাগঞ্জে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, তাই বেলাবেলি এখানে লোকে দোকানবাজার সেরে ফেলে সন্ধের মধ্যে বাড়ি ঢুকে পড়ে, বন্য জন্তু না থাকলেও অন্ধকারে জঙ্গলে পথ হারয়ে ফেলা বিচিত্র নয়। তো, সে যাই হোক, সেখানে গিয়ে জিগ্যেস করতেই রেঞ্জার সাহেবকে দেখিয়ে দিল। তাঁকে দেখে এবার আমরা সত্যিই ভির্মি খেলাম। আমি নিজে চরম রোগা প্যাংলা ছেলে, আমার সামনে যাঁকে দেখতে পাচ্ছি, সেই রেঞ্জার সাহেব আমার থেকেও বেশি রোগা, স্রেফ ফুঁ দিলে উড়ে যাবেন এ রকম চেহারা, ওই শরীরে সাদা শার্টটাও যেন লাগছে কাকতাড়ুয়ার মতো, একটা বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছেন। বুকে বল এল। গিয়ে মিহি গলায় দাবি পেশ করলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে, বেড়াতে এসেছি, দয়া করে আজ রাতের মতো বাংলোটা যদি দ্যান … উনি ততোধিক মিহি গলায় বললেন, বাংলো তো ও ভাবে দেওয়ার নিয়ম নেই, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বড় বড় অফিসাররা যখন আসেন, তখন তাঁদের জন্য এই বাংলো রাখা থাকে। এমনিতে এখানে থাকতে হলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লিখিত অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। আর সেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস হল গিয়ে শিলিগুড়িতে। সুতরাং … … More জলু – সপ্তম পর্ব

জলু – ষষ্ঠ পর্ব

সবই ঠিক আছে, গোলমালটা বাধছিল আসল জায়গায়। অনেক মারপিট করে টিমোশেঙ্কোর ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিক্সের বই তো জোগাড় হল, বোর্ড টি-ও পেয়ে গেছিলাম, কিন্তু মাথায় যে কিছুই ঢোকে না! আজীবন বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র, ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে তো বাংলাতে বই হয় না, মেকানিক্সের বই খুললেই কেমন মনে হত পাতার ওপর পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্লাসে বেশির ভাগ প্রোফেসরই বাংলায় কথা বলতেন, তাঁদের অবস্থাও যে আমার থেকে খুব ভালো ছিল, এমন নয় – কারণ অন্যান্য ব্যাচের মতই আমাদের ব্যাচেও কয়েকটি অবাঙালি ছেলে ছিল, তারা হাত তুলে নিজেদের বাংলা বুঝতে পারার অপারগতা জানালে তাঁরা বেশ কষ্ট করে ইংরেজিতে শিফট করতেন। … More জলু – ষষ্ঠ পর্ব

জলু – পঞ্চম পর্ব

ফিরে আসি কলেজের সেই কনসেশন ফর্মে। একটাই ফর্ম হত, যাওয়া এবং ফিরে আসার জন্য। যে ভদ্রলোক ফর্মগুলো ইস্যু করতেন, ওয়ার্কশপ ইন্সট্রাক্‌টর, তিনি বেশ দয়ালু প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্রদরদী। পুরো ফর্মটা লিখতেন চেলপার্কের সবুজ রংয়ের কালিতে। নো ডটপেন। ডটপেন তখন প্রচলিত হলেও কালিপেনও চলত। ছাত্রদের কেবল কাজ ছিল নিজেদের সুবিধের জন্য চেলপার্কের একই রংয়ের আরেকটা কালির শিশি কিনে আনা, একটা কালি-পেন, জনসনের ইয়ার বাড, অভাবে তুলো, আর এক শিশি জিওলিন; এই কটা জিনিস নিজেদের পজেশনে রাখা। … More জলু – পঞ্চম পর্ব

জলু – চতুর্থ পর্ব

চা বাগান কোথায় গিয়ে শেষ, কেউই কখনও দেখি নি, হস্টেলের ছাদ থেকেও চা বাগানের শেষ দেখা যায় না। অন্যপ্রান্তে খালি আকাশ। খালি বটে, তবে এই খালি আকাশই জাদু দেখায় নভেম্বরের মাঝ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এটা ক্যাম্পাসের উত্তর দিক। ঝকঝকে হেমন্তের ওয়েদারে আকাশের গায়ে ফুটে ওঠে হিমালয়, পুরো নীল রংয়ের। আর সেই হিমালয়ান রেঞ্জের মাথায় মুকুটের মত ঝকঝক করে তিনটে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ : কাঞ্চনজঙ্ঘা, সান্দাকফু, ফালুট। লোকে পয়সা খরচা করে এদের দেখতে আসে কত দূর দূর থেকে, আমরা হস্টেলের ছাদে বসে, নিজের বেডে বসে দিনের পর দিন দেখেছি কাঞ্চনের রূপ, কখনও টকটকে লাল, কখনও আগুনের হল্কার সোনালী হলুদ রং, কখনও ধবধবে সাদা, কখনও বিষণ্ণ নীল। তবে বছরে ঐ একটা সময়েই দেখা যেত, এক মাসের জন্য। তার পরেই কুয়াশায় ঢেকে যেত তরাই ডুয়ার্স। সে আরেক রূপ। … More জলু – চতুর্থ পর্ব

জলু – তৃতীয় পর্ব

চার থেকে পাঁচ দিন চলত এই উৎসব। শেষ দিন হত মাস্‌ র‌্যাগিং। সেদিন মহোৎসব। সে দিন সমস্ত অ্যাক্টিভ র‌্যাগাররা দলবদ্ধভাবে ছানাদের নিয়ে যেত কলেজ ক্যাম্পাসের পেছনের মাঠ পেরিয়ে চা বাগানে। ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান। সাধারণত কলেজে অ্যাডমিশন হত আগস্ট মাসে, তখন তরাইতে ভরা বর্ষা। ফলে এক আর দু নম্বর হস্টেলের পেছনের মাঠ থাকত সম্পূর্ণ কাদা-পাঁকে ভরা। সেই পাঁকে ছানা পোনা সকলে মিলে সকলকে কাদা পাঁক মাখানো হত, মূলত ছানাদেরই মাখানো হত। কাদা মেখে যখন সবাই ভূত, কাউকে দেখে চেনার উপায় নেই, তখন জামাপ্যান্ট খুলে কেবল মাত্র জাঙিয়া সম্বল করে, চা বাগানের ভেতর দৌড়। সর্বাঙ্গে কাদা থাকায় আলাদা করে চেনার উপায় থাকত না কার পরনে জাঙিয়া আছে, কার পরণে কিছুই নেই। হুল্লোড় হইচইতে ভরে যেত নিস্তব্ধ চা বাগান। চা-পাতা তোলা মদেশিয়া কামিনের দল সেদিন ধারেকাছে ঘেঁষত না। … More জলু – তৃতীয় পর্ব