জলু – অষ্টম পর্ব

সপ্তম পর্বের পর

কলেজে কোটা ছিল। নর্থ ইস্ট কোটা। উত্তর পূর্বের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর থেকে কিছু ছেলেপুলেকে পাঠানো হত ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে। “মেনস্ট্রিম” ভারতীয়দের সাথে তাদের প্রায় কিছুই মিলত জুলত না, তারাও মেলাবার চেষ্টা করত না, ফলে একটা দূরত্ব সবসময়ে বজায় থাকত। অনেক অনেক বেশি ওয়েস্টার্নাইজ্‌ড, গীটার, কুংফু ইত্যাদি শখ, গড়পড়তা বাঙালিদের চোখে তারা তো আলাদা ঠেকবেই। তখনও উত্তর পূর্ব ভারত খুব একটা পরিচিত ছিল না বাকি ভারতের কাছে। সরকার থেকে তাদের ফ্রি-তে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সুযোগটা করে দেওয়া হত, ফলে প্রতি বছরই বেশ কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসত, হয় তো এখনও আসে, জলপাইগুড়ির কলেজে, হয় তো আরও অনেক কলেজেই। শিবপুর যাদবপুরে এই জনগোষ্ঠী পরিচিত ছিল ‘চ্যাং’ নামে, জলুতে এদের নাম ছিল ‘ডোঙা’।

মূলত মেঘালয় মিজোরাম মণিপুর নাগাল্যান্ড বা সিকিমের অধিবাসী, উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত, ধর্মমতে খ্রীস্টান এই ডোঙারা বাকি ভারতীয়দের সাথে একেবারে মিশত না, ভারতীয়রাও তাদের সাথে দূরত্ব রেখে চলত। এর প্রধান কারণ, আমাদের যা মনে হত তখন, এরা মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধের হত না। কলেজে আসত সরকারের পয়সায়, পড়াশোনা প্রায় একেবারে করত না, বছরের পর বছর ফেল করত, তারপর সাত বছরের শেষে হয় বিতাড়িত হত কলেজ থেকে নয় তো কোনওরকমে ঘষেঘেস্টে পাশ করে বেরোত। উত্তর পূর্বে সত্যিই ইঞ্জিনীয়ারের খুব আকাল, তাই দেশে ফিরলে তাদের চাকরির অভাব হত না। আর, এক বছর ফেল করলেই সরকারের তরফ থেকে ভাবা হত যে তাদের নিশ্চয়ই ওখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে, তাই পাশ করতে পারছে না, তাই ফেল করলে অনুদানের পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। অন্য অধিকাংশ ছেলে যেখানে বিদায়ী সিনিয়রদের থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড ঝরঝরে সাইকেল কিনে পরের তিন চারটে বছরের গতি করে নিত, সেখানে ডোঙারা এসেই প্রথমে হিরো রেঞ্জার বা স্ট্রীট ক্যাট জাতীয় সাইকেল কিনে জাঁকিয়ে বসত, ফার্স্ট হ্যান্ড। জলপাইগুড়ি টাউনে এদের দেশোয়ালিদের ঠেক আছে, অনুদানের পয়সায় সেখানে এরা গিয়ে গাঁজা, হ্যাশ, চরস, এন-টেন ইত্যাদি দামী নেশার সরঞ্জাম কনজিউম করত আর ব্যোম হয়ে রাত দুপুরে ঘরে ফিরত। নেশার জিনিস যে হস্টেলের বাকি জনতার কাছে একেবারে অচেনা ছিল, তা নয়, তবে তা সীমিত ছিল পালাপার্বণ উপলক্ষ্যে, গাঁজাতেই। বাকি জিনিস, নাঃ, হস্টেলের বেশির ভাগ ছেলেদের কাছেই অ্যাফোর্ডেবল ছিল না। গাঁজার চাষও হত স্মল স্কেলে এক নম্বর আর দু নম্বর হস্টেলের ভেতরের কম্পাউন্ডে, ফলে ওটুকু সহজলভ্য ছিল।

ডোঙাদের কেউ কেউ কুংফু ক্যারাটেও জানত। আমাদের সময়ে ফোর্থ ইয়ারে একজন ছিল, সিকিমের কোন এক্স মন্ত্রীর ছেলে, কী-যেন সুব্বা, ফোর্থ ডান ব্ল্যাক বেল্ট। সে নাকি নিজের পায়ের ফিমার বোনের ওপর বেসবল ব্যাট মটকে ভেঙে দেখিয়েছিল। সবই শোনা কথা, তখন শোনা কথাতেই বিশ্বাস বেশি হত, সিনিয়ররা কোনও গল্প শোনালে সেগুলো আলাদা করে ভেরিফাই করা দরকার বলে মনেই হত না।

তো, এই রকম কিছু কুংফু-বিশারদের দাক্ষিণ্যে ‘ডোঙা’দের ক্যাম্পাসে রেলার শেষ ছিল না। কেউ ওদের দিকে তাকালেই তারা নাকি সরাসরি এগিয়ে এসে চ্যালেঞ্জ করত, হে, হোয়াই আর য়ু স্টেয়ারিং অ্যাট মী? এটাও শোনা কথা, আমি নিজে কাউকে দেখি নি এই ধরণের পাঙ্গা নিতে। সন্তোষজনক উত্তর না পেলে নাকি হাতের তেলোর চাপে টেবিলের ওপর রাখা চায়ের গ্লাস স্ম্যাশ করে তারা কখনও কখনও রাগও প্রকাশ করত।

মোদ্দা কথা, এই সব শোনা এবং দেখা ঘটনাবলীর কারণে ডোঙাদের আলাদা এনটিটি হিসেবেই আমরা ট্রীট করতাম। ‘ওদের’ সাথে ‘আমাদের’ মেলে না একেবারেই, তাই কেউ কারোর সাতে পাঁচে লাগত না। র‌্যাগিংও করত না কেউ ওদের, ওরা হস্টেলে এসেই ওদের সিনিয়রদের ঘরে চলে যেত, সেখানে কী হত কেউ জানে না, কিন্তু মারধোর হত না।

তবে সব ডোঙাই এমন ছিল না, কেউ কেউ ভালোমানুষও হত, তবে সে কোটিকে গুটিক। আমাদের ব্যাচে দুজন ছিল, তাদের মধ্যে একজন, স্যামসন (নাম বদলানো) তো সেকেন্ড ইয়ারেই নেশার এমন তূরীয় লেভেলে চলে গেছিল, তার সারা গায়ে হাতে আমরা দেখতে পেতাম পোড়া পোড়া ছ্যাঁকার দাগ, সেগুলো ইঞ্জেকশনের দাগ, নাকি নিজেই নিজেকে সিগারেট দিয়ে ছ্যাঁকা দিত, জানি না। সবসময়ে চলত ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে, একদিন মনে আছে, ক্যান্টিনে থালা নিয়ে দাঁড়িয়েই আউট অফ ব্লু চোখ উল্টে দড়াম করে পড়ে গিয়ে ফিট।

অন্যজন ছিল আবার খুব ভালো ছেলে, মোটামুটি মিশুকে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে অনেক গল্প করার চেষ্টা করত। কখনও পাঙ্গা নেয় নি তার ক্যাম্পাসজীবনে, কারুর সাথে। তো, এই রকম বিবিধ ডোঙা এবং ডুঙি নিয়ে চলত ক্যাম্পাসজীবন। আমরা এবং ওরা হয়ে। আমরা বাওয়ালি করতাম আমাদের মত করে, ওরা ওদের মত করে, কখনও একে অপরের পেছনে লাগার চেষ্টা করত না, কিন্তু ওদের ঐ ‘রেলা’ আমাদের প্রায় কেউই খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। জুনিয়র ডোঙাও সিনিয়র নন-ডোঙা ছাত্রকে দেখলে তেমন কোনও সম্মান দেখাবার চেষ্টা করত না, ছেলেপুলে মনে মনে রাগ করত, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।

কেসটা ঘটল সেকেন্ড ইয়ারের গোড়ার দিকে। ডোঙারা আলাদা রুমে থাকত, তাদের কোনও রুমমেটও জুটত না, আর প্রাইভেসি রাখার জন্য তারা সমস্ত জানলার কাচে সাদা পেন্ট করে রাখত বা খবরের কাগজ সাঁটিয়ে রাখত। তো, স্যামসনের ঘরের জানলার কাচের পেন্ট একটা জায়গায় একটু চটে গেছিল, উঁকি মারলে ঘরের ভেতরটা বেশ পরিষ্কারই দেখা যেত। স্যামুয়েলের পাশের রুমে থাকত বিশু ও তার অন্যান্য রুমমেটরা। তো, বিশু সেদিন সন্ধ্যেবেলায় খেয়াল করেছে স্যামুয়েল হাত ধরে একটা ডুঙিকে, মানে ঐ নর্থ ইস্টের কোনও মেয়েকে, নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেছে। এমনিতে ছেলেদের হস্টেলে মেয়েদের ঢোকা বারণ, তবে কখনও কখনও কারুর মা দিদি তো আসেনই, তাই এমনিতে অত কিছু ফলো করা হত টত না।

এবার, মা-দিদিদের দেখলে চেনা যায় (কীভাবে যায় জানি না, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করতাম, চেনা যায়), ডোঙাদের সাথে ডুঙি দেখলে তো কিছু চেনা যায় না, সবই তো এক রকমের মুখ! বিশু একটা আন্দাজ করেছিল, কিন্তু একে স্যামসন নেশাখোর ডোঙা, তায় শিওর নয় মেয়েটি স্যামসনের রিলেটিভ না গার্লফ্রেন্ড, তাই সে কোনও আওয়াজ তোলার সাহস পায় নি। কেবল সেই সন্ধ্যেয় তার বাথরুম যাবার ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গেল।

তিনবার যাতায়াতেই ফল মিলল, জানলার চটে যাওয়া পেন্টের ফাঁক দিয়ে বিশু কিছু উত্তেজক দৃশ্য দেখে ফেলল এবং উইংয়ে উইংয়ে দৌড়তে দৌড়তে খবর প্রচার করে দিল, জনতা, আসো আসো, দেখে যাও, স্যামসন রুমে মাগী এনে লাগাচ্ছে।

এমন পূর্ণ আমিষ কেচ্ছায় হস্টেলবাসী নিরুপদ্রবে ঘরে বসে থাকতে পারে না, অতএব এক মিনিটের মধ্যে স্যামসনের ঘরের সামনেটা পুরো ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে গেল ও সকলে একসঙ্গে সেই ফুটো দিয়ে উত্তেজক দৃশ্য দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

এতদৃশ ঠেলাঠেলিতে স্বভাবতই উইংয়ের নীরবতা ভঙ্গ হল এবং বাকিদের হতাশ করে জামাপ্যান্ট পরা অবস্থায় স্যামসন গোলমাল শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে, নিজেরই জানলার সামনে লম্বা ভিড় দেখেই, সাথে সাথে তিনপা পিছিয়ে দরজা বন্ধ এবং লক্‌।

সেই প্রথম বুঝলাম, এবং বাকি সমস্ত পাব্লিকও বুঝল, মাসের কাছে ইন্ডিভিজুয়াল কাৎ। জনতার মধ্যে অতএব মরাল মেসোমশাইগিরি চাগিয়ে উঠল, স্যামসনের দরজায় লাথির পর লাথি পড়তে লাগল, শালা, হস্টেলের মধ্যে মেয়ে নিয়ে এসে ফুর্তি? বেরো শালা। এক অতি উৎসাহী পাবলিক স্যামসনের জানলার কাচগুলো ভেঙে দিল। এর পরে আর স্যামসনের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়, দরজা তাকে খুলতেই হল, কিন্তু দরজা খুলে বেরোল মেয়েটি, জামার বোতাম আটকাতে আটকাতে।

মেয়েটিকে দেখামাত্রই আধা-হিংস্র জনতার মধ্যে এক মুহূর্তে শিভালরি চাগিয়ে উঠল, তাকে বলা হল, তুমি চুপচাপ এক্ষুনি হস্টেল থেকে চলে যাও, কেউ কিছু বলবে না।

মেয়েটাও আর কিছু বলার সাহস না পেয়ে, পেছন ফিরে একবার স্যামসনের দিকে তাকিয়ে, মাথা নিচু করে চলে গেল। জনতা ঢুকল, সিড়িঙ্গে, নেশায় আধমরা স্যামসনকে কলার ধরে টেনে তুলল, তারপর শুরু হল চড়থাপ্পড়ের বৃষ্টি। তখনও কেউ ভালো ইংরেজি বলতে পারতাম না, তাই ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আর চোখা চোখা গালাগালিতে (সিনেমা দেখে ইংরেজি গালাগালি অনেক শেখা যায়) তাকে অনেক নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হল।

তার মধ্যেই একজন বলল, ওকে মারিস না, মরে যাবে, ওকে কোনও রুমে লক করে রাখ আজ রাতের মত, কাল হস্টেল সুপারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। সবাই সেটা মেনে নিল, একটা খালি রুমে ওকে লক করে রাখা হল। স্যামুয়েলের এক ছানা থাকত আমাদেরই হস্টেলের নিচের তলায়, সে তখন ফার্স্ট ইয়ার, সে হঠাৎ সিনিয়রের দুর্দশা সইতে না পেরে ওপরে উঠে এসে আমাদের সাথে খুব উদ্ধত ভাষায় আঙুল তুলে তুলে ঝগড়া করতে শুরু করল। ফার্স্ট ইয়ারের ছানার এমন ঔদ্ধত্ব সেকেন্ড ইয়ার কেন মেনে নেবে, অতএব অচিরেই সে-ও প্রচুর চড় খেল, এবং স্যামুয়েলের সাথে তাকেও লক করে রাখা হল একই রুমে।

ঝামেলার তখনকার মত শেষ ধরে নিয়ে সবাই যে যার রুমে ফিরে যাচ্ছি, এমন সময়ে কে যেন খবর দিল, ফোর্থ ইয়ার হস্টেল থেকে সুব্বা আসছে।

কে কীভাবে খবর দিয়েছিল জানি না, তবে তার পরের ঘটনাগুলো ম্যাজিকের মত ঘটল। সুব্বা ফোর্থ ডান ব্ল্যাক বেল্ট। বেসবল ব্যাট মটকে ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রাখে। অতএব, দেড়শো ছেলে একসাথে নেমে এল নিচে, প্রথমে হস্টেলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে তালা মারা হল। তারপর ম্যাজিকের মত সকলের হাতে চলে এল অস্ত্র। জিনিসগুলো এক্স্যাক্টলি আমাদের ঘরেই ছিল, কেউ জানতাম না, কী করে যে সেই মুহূর্তেই জেনে ফেললাম তাও মনে পড়ছে না, কেবল মনে আছে আমার ঘরেই লকারের মাথা থেকে বেরোল একটা হকিস্টিক, একটা চেন। আমি হকিস্টিকটা নিলাম, আমার রুমমেট কেকে নিল চেন। কীভাবে ওগুলো চালাতে হয়, প্রায় কেউই জানত না, আমি তো জানতামই না, কিন্তু হাতে ওগুলো থাকলে কনফিডেন্স বাড়ে। প্রায় পুরো হস্টেল এই রকম চেন রড হকিস্টিক ইত্যাদি জিনিস নিয়ে নিচে মেন গেটের সামনে লবিতে পজিশন নিল, কেবল মাত্র একজন ফোর্থ ডান ব্ল্যাক বেল্টের মোকাবিলা করার জন্য।

তিন মিনিটের মধ্যেই সুব্বা এসে দাঁড়াল আমাদের হস্টেলের গেটের সামনে। বন্ধ কোলাপসিবলের ওপ্রান্ত থেকে অস্ত্রধারী সেকেন্ড ইয়ারকে দেখে সুব্বা একবার মুচকি হাসল শুধু। তারপরে সঙ্গী বাকি ডাকাবুকো ডোঙাদের সরিয়ে দিয়ে নিজে সামনে এসে বলল, কোনও ঝামেলায় যেতে চাই না, আমরা স্যামসনকে নিয়ে যেতে এসেছি শুধু। ওকে আমাদের হাতে দিয়ে দাও। পুরো সেকেন্ড ইয়ার গর্জে উঠল, নেভার। মরাল মেসোমশাই হবার এমন সুযোগ পাওয়া গেছে, তাকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি? কাল সে পেশ হবে হস্টেল সুপারের সামনে, তারপরে জো হোগা সো হোগা।

সুব্বা দু একবার নেগোশিয়েশনের চেষ্টা চালালো, কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। খানিকক্ষণ উত্তপ্ত এবং ঠান্ডা বাদানুবাদের পর সুব্বা এবং তার দলবল ফেরৎ গেল খালি হাতে, “এর ফল ভালো হবে না” এই হুমকি দিয়ে। ছেলেপুলের মনে তখন গুচ্ছ উৎসাহ। সুব্বা ফিরে গেছে, কারুর গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত পড়ে নি, এর চেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট আর কী হতে পারে! উত্তাল আওয়াজ টাওয়াজ দিয়ে তাকে বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়া হল। ছেলেপুলের তখন জোশ চেপে গেছে, সেকেন্ড ইয়ারের পাঙ্গা বলল, আজই শালা ক্যাম্পাসে ডোঙাদের রেলার শেষ দিন। এর পর থেকে ওরা আর কোনওদিন আমাদের সাথে রোয়াব নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে না। এই জনতা, স্যামসনের সাইকেলটা নিয়ে আয় তো! ওটা আজ জ্বালাব।

ঝাঁ চকচকে স্ট্রীট ক্যাট সাইকেল নিয়ে বীরদর্পে জনতা উঠে এল ছাদে। বিশাল বড় হস্টেলের সুবিশাল ছাদ। ছাদময় ঢাউস ঢাউস জলের ট্যাঙ্ক, আর পাইপে পাইপে কানেক্ট করা। সেই একটা পাইপের মাথায় উল্টো করে সাইকেলটাকে ঝুলিয়ে পেট্রল ঢালা হল। পাঙ্গা তাতে অগ্নিসংযোগ করল। তারপর, সাইকেল যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে, পাঙ্গা বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে সেই আগুন থেকে একটা বিড়ি ধরিয়ে আনল।

এর পর স্যামসনের ছানারও নতুন সাইকেল জ্বালানো হল। ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা নয়, মূলত শোনা-কথার ভিত্তিতে ডোঙাদের ওপর সক্কলে এত্তো খচে ছিল বছরের পর বছর ধরে, সেই অগ্নিকান্ড দেখতে থার্ড ইয়ার হস্টেল থেকে দলে দলে ছেলেপুলে চলে এল। সোল্লাসে চীয়ার্স ধ্বনিতে মুখরিত হল ক্যাম্পাস।

এর পর স্যামসনকে হস্টেল সুপারের কাছে পেশ করা হয় পরদিন, কেস বেশিদূর এগোয় নি, জনতারও আর এন্থু ছিল না, মোটামুটি ওয়ার্নিং দিয়েই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, পাঙ্গাকেও আলাদা করে ডেকে ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছিল সাইকেল জ্বালানোর জন্য, কিন্তু…

যেটা হল, তারপর থেকে নাকি ডোঙাদের ঐ অস্বাভাবিক রোয়াব একেবারে বন্ধ হয়ে গেছিল। তাদের দিকে তাকালেও আর কেউ হোয়াই স্টেয়ারিং অ্যাট মী করে কেউ আর তেড়ে আসত না।

সিকি শতাব্দী বাদে যখন পেছন ফিরে এই ঘটনার দিকে তাকাই, আজকের অনেকটা পরিণত বুদ্ধিতে বুঝতে পারি, ন্যারেটিভ বিল্ড আপ কীভাবে হয়। ন্যারেটিভের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে কীভাবে একটা জনগোষ্ঠীকে একেবারে কোণঠাসা করে একেবারে ইরেলিভ্যান্ট করে দেওয়া যায়। পৃথিবীর যে কোনও দেশে, যে কোনও অঞ্চলে, যে কোনও পরিস্থিতির মব কালচার, সংখ্যাগুরুর ‘খতরে মে হ্যায়’ মানসিকতা, এই রকম হুবহু মিলে যায়। আজ সারা ভারত জুড়ে আমরা যে জিনিস দেখছি, সেদিন জলুর ক্যাম্পাসে, দু নম্বর হস্টেলে, তার ছোট স্কেলে একটা ডেমো দেখেছিলাম। আমি নিজে ছিলাম সেই ডেমোর অংশ।

আর এই ন্যারেটিভ নিয়ে খেলা আমাদের ক্যাম্পাসে একবার হয় নি। একাধিকবার হয়েছিল। আমাদের হস্টেলের নাইটগার্ড, আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচিত বিজলিদাকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছিল। নির্দয়ভাবে। তুচ্ছ সন্দেহের বশে। সে গল্প পরের পর্বে করা যাবে।

স্যামসন সেকেন্ড ইয়ার থেকেই ফেল করতে শুরু করে। তারপর কী করে, খবর রাখি নি আর।

… চলবে


1 thoughts on “জলু – অষ্টম পর্ব

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.