প্রমাণপত্রের জন্ম এবং সর্ষেদানারা – পর্ব ৫

শেষ পর্ব লিখে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল, ঠাঁইনাড়া হয়েছি সদ্য, লেখার পরিবেশ তৈরি করে উঠতে পারছিলাম না। অনেকেই পেছন দরজায় এসে তাগাদা দিয়ে গেছেন বারবার, তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। 

এই পর্বে কিছু অশ্লীল শব্দটব্দ আছে। আপনার অস্বস্তির কারণ হতে পারে। খিস্তিতে অসুবিধা থাকলে এই পর্বটা পড়বেন না। বিনীত অনুরোধ। 

শনিবার। ঘুম ভেঙে গেছে সকালেই, খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লাম। আমার ফেরার ট্রেন কামরূপ এক্সপ্রেস, নিউ আলিপুরদুয়ার জংশনে আসবে বেলায় দুটোর পরে। মানে সকাল দশটা নাগাদ চার্ট ফাইনাল হলে জানতে পারব, আমার সীট কনফার্মড হয়েছে কি হয় নি। ওয়েটিং লিস্ট পাঁচ, হওয়া না হওয়ার চান্স ফিফটি ফিফটি।

আটটা নাগাদ বেরোলাম। আজ আর কোনও কাজ নেই। শুধু ফেরার টেনশনটা রয়ে গেছে, তবে কত চিন্তারও কিছু নেই, ট্রেনে যদি কনফার্ম না-ও হয়, সোজা শিলিগুড়ি চলে যাবো। ওখানে কলকাতার বাস ধরে নেব বিকেলের দিকে। সাইটে চেক করে নিয়েছি, বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। দাম একটু বেশি, কিন্তু কী আর করা যাবে। সবদিক দিয়েই টাকাপয়সার জলবৃষ্টি হচ্ছে, হোক আরও খানিক, অন্তত কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরার টিকিটটা কনফার্মড আছে।

হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম চৌপথী ছাড়িয়ে আরেকটু সামনের দিকে। হাতের মোবাইলে গুগল ম্যাপ বলছে, এই রাস্তাতেই আরেকটু এগিয়ে ডান দিকের রাস্তায় ঢুকলে আলিপুরদুয়ার সদর হাসপাতাল। যা বছর পাঁচেক আগেও পরিচিত ছিল মহকুমা হাসপাতাল নামে, যেখানে চার দশকেরও বেশি সময় আগে আমার জন্ম হয়েছিল।

চৌপথী থেকে একটু এগিয়ে ডানদিকের এলাকাটার নাম মারোয়াড়ি-পট্টি, চারপাশের দোকানঘরে লেখা নাম দেখে বুঝলাম। সেখান থেকে একটা গলিমত রাস্তা ঢুকে গেছে ডানদিকে, একটা মোটরগাড়ি ঢুকে যেতে পারে, এই রকমের চওড়া, ম্যাপ বলছে, এটাই হসপিটাল রোড, আমাকে এইখান দিয়েই ডানদিকে যেতে হবে।

ঢুকলাম। হ্যাঁ, হসপিটাল রোডই নাম বটে। দু পাশে ইতস্তত ওষুধের দোকানের ভিড়, এই সকালেও তারা খুলে গেছে। কিছু খাবার দোকান, উনুন ধরানো হয়েছে, উনুনে ধোঁয়া উঠছে, সামনে কাঁচের বয়ামে বিস্কুট রাখা, এদিক ওদিক লোকেদের আনাগোনা। চারশো মিটার এগোতেই দেখলাম আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতাল লেখা একটা বড়সড় তোরণ টাইপের গেট।

এখানেই আমি জন্মেছিলাম।

ক্যামেরা নিয়ে আসি নি, পকেটে মোবাইল ক্যামেরা আছে, কিন্তু … ছবি তুলতে ইচ্ছে হল না। অলস পায়ে ঢুকলাম তোরণ পেরিয়ে। ছোটখাটো সাইজের হাসপাতাল, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং এদিক ওদিক, মোটের ওপর বেশ পরিচ্ছন্নই। কোথাও কোনও অবাঞ্ছিত নোংরা নেই। কুকুর বেড়াল নেই।

alipurduar jelahaspatal
আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতাল। ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। 

বেরিয়ে এলাম। সাড়ে নটা বাজে। আর খানিকক্ষণের মধ্যেই জানা যাবে রিজার্ভেশনের ফাইনাল স্টেটাস। এখনও দেখাচ্ছে, চার্ট নট প্রিপেয়ার্ড।

হোটেলে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম, রিসেপশনে গিয়ে বিল ইত্যাদি মেটালাম। দশটা বেজে পাঁচ মিনিটে আরেকবার আইআরসিটিসিতে গিয়ে লগিন করে দেখলাম, না, রিজার্ভেশন ওয়েটলিস্টেই রয়ে গেছে, কনফার্মড হয় নি। ঝটপট শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার বাস বুক করে নিলাম। এনবিএসটিসির এসি বাস পেয়ে গেলাম, সন্ধে সাড়ে ছটায় ছাড়বে তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে। এইবার এখান থেকে বেরোবার পালা।

হোটেলের রিসেপশন থেকেই জেনে নিলাম, চৌপথীর মোড় দিয়েই শিলিগুড়ির বাস যায়। সেইমত তৈরি হয়ে বেরিয়ে গিয়ে মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। শনিবারের সকাল, অনেকটা দেরিতে হলেও আলিপুরদুয়ার জেগে উঠেছে এইবারে – চারপাশে অটোরিক্সা আর রিক্সাদের ভিড়, একটু সামনে ট্রেকারের দল হাঁকছে, মাথাভাঙা দিনহাটা কুচবিহার কুচবিহার কুচবিহাআআআর

এগারোটার সময়ে এল শিলিগুড়ির বাস। অলরেডি ভর্তি, তবে দাঁড়াবার জায়গা আছে। ঘণ্টা আড়াই তিন নেয়, লোক উঠবে নামবে, কখনও না কখনও ঠিক বসার জায়গা জুটে যাবে। উঠে পড়লাম, পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাস চলল শিলিগুড়ির দিকে, উত্তরবঙ্গের ছবি দুপাশে উপভোগ করতে করতে আধঘণ্টার মাথায় বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম।

তৃণমূলার বিজেপির পতাকাতেই চারিদিক ছয়লাপ, সদ্য পেরিয়ে আসা নির্বাচনের ছাপ মুছে ফেলার সময় এখনও আসে নি, বেশ বোঝা যাচ্ছে তৃণমূলের সমান সমান টক্কর দিয়েছে গেরুয়া পার্টি, পতাকার ঘনত্বেই তার মালুম পড়ছে।

সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি, তবে খিদে পায়ও নি তেমন। বাস ঢুকল ফালাকাটা হয়ে জলপাইগুড়িতে, এবং ময়নাগুড়ি বাইপাস ধরে, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের গেট পেরিয়েই এগলো শিলিগুড়ি থেকে। চলন্ত বাসের জানলা থেকে ঝট করে একটা ছবি তুলে ফেললাম কলেজের গেটের।

এই রাস্তা আমার মুখস্ত। চার বছর অনবরত যাতায়াত করেছি এই রাস্তা ধরে, একটু পরেই মোহিতনগর সাবস্টেশন, যেখান থেকে আমাদের কলেজের ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই হত, আসাম মোড়ের পেট্রল পাম্পটা এখনও তেমন আছে, আরেকটু রঙীন হয়েছে মনে হল। আর, জায়গায় জায়গায় ডাইভার্সন চলছে, রাস্তাটা চওড়া হচ্ছে, কোথাও ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে।

আড়াইটে নাগাদ শিলিগুড়ি ঢুকে গেলাম আর পৌনে তিনটে নাগাদ তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের বাইরেটায় নামিয়ে দিল বাস। টার্মিনাসের বাইরে অনেক খাবার হোটেল, একটাতে ঢুকে গেলাম এবং পেট ভরে পাবদামাছের ঝোল, বেগুনভাজা, আলুভাজা ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেলাম। এইবারে অপেক্ষা তিনঘণ্টার।

টার্মিনাসের ভেতরে বসার প্রচুর জায়গা, একটা জায়গা খুঁজে খানিকক্ষণ বসে রইলাম। ভরপেটে ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু একলা একলা লাগেজ নিয়ে ঘুমনোটা সেফ নয়, তাই খানিক ঘুরতে লাগলাম। টার্মিনাসের অন্যপ্রান্তে একটা মার্কেট কমপ্লেস ছিল, এসজেডিএ মার্কেট, ওখান থেকে একটা টু-ইন-ওয়ান কিনেছিলাম কলেজ ছাড়ার আগে, সেই টু-ইন-ওয়ানে আজও আমাদের বাড়িতে সকালে এফএম বাজে। মার্কেটে ঢুকলাম, কিন্তু কুড়ি বছর বাদে গিয়ে দেখলাম মার্কেটটার ছন্নছাড়া দশা। প্রচণ্ড নোংরা, বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ, আর যে কটা খোলা, তারাও সেই শস্তার চীনা মালের দোকান নয়, নিতান্তই ট্র্যাভেল এজেন্ট, দর্জির দোকান বা মণিহারি দোকান। সর্বত্র ভেসে বেড়াচ্ছে ইউরিনালের ঝাঁঝালো গন্ধ।

নাকে হাত চাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ঘুমটা কেটেছে, তবে এখনও দুঘণ্টা বাকি।

অনেক, অনেক বছর আগে, নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের তিন দিনের সোশ্যাল অ্যাটেন্ড করে আমরা এনবিএমসির বাসে করে শেষরাতে ফিরেছিলাম, এই তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসে। সেই সময়ে বাস টার্মিনাসটা এতবড় ছিল না সম্ভবত, কিংবা হয় তো এই রকমই ছিল – মনে নেই, কেবল মনে আছে আমরা জনা দশেক ছেলেমেয়ে হা-ক্লান্ত অবস্থায় ভোর চারটের সময়ে এসে নেমেছিলাম মেডিকেল কলেজের বাসে করে, জলপাইগুড়ির কলেজে ফেরার বাস সকাল সাড়ে ছটায়, তাই তেনজিং বাসস্ট্যান্ডের চাতালে বসে বসে সময় কাটানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। … বসে থাকতে থাকতে, আমার ঠিক পাশেই, ব্যাগে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল আমাদেরই ব্যাচের একটা মেয়ে, মনে আছে, কেমন মোহাবিষ্ট হয়ে মেয়েটির মুখ দেখছিলাম আধো অন্ধকারে। কেমন মিষ্টি, কোমল, মায়াবী একটা মুখ, কেমন পরম নিশ্চিন্তে ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখনও প্রেম আসেনি জীবনে, তখনও নারীস্পর্শের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় নি জীবনের ঝুলিতে, এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে হয়েছিল ঐ ঘুমন্ত মুখটিকে আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখার।

না, ছুঁই নি। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল, সেই বিশ্বাসে ভর রেখেই মুখটাকে দেখছিলাম, শুধু দেখছিলাম। ভোরের আলো তখনও ফোটে নি, আমার সেই চাহনি কেউ দেখতে পায় নি।

সেই চাতালটা আজ, বাইশ বছর বাদে, আমার চোখের সামনে। সেখান দিয়ে একটা লোক নেমে এল ঈষৎ টলতে টলতে, একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে এক সময়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, যাবা নাকি, কালিম্পং, গ্যাংটক? সীট আসে সীট আসে, যাবা তো বলো ব্যওস্তা করি দিই।

দুটো নামই খুব লোভনীয় হওয়া সত্ত্বেও আমি উদাসীনভাবে ঘাড় নাড়লাম। না, কালিম্পং বা গ্যাংটক যাবার নেই আমার।

আধমাতাল লোকটি ছাড়ার পাত্র নয়। অ – গ্যাংটক যাবা না – কোথায় যাবা?

আমার বয়ে গেছে ওর সাথে কথা বলতে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ের বসে রইলাম। এখানে আক্ষরিক অর্থে দেশবিদেশের লোক যাওয়া আসা করে, কে কোন মতলবে ঘুরছে কে জানে।

লোকটা নাছোড়বান্দার মত একই প্রশ্ন আরও তিন চারবার করে শেষে হতোদ্যম হয়ে রণে ভঙ্গ দিল।

সাড়ে ছটায় বাস এল। লাগেজ ভরে, প্যাসেঞ্জার তুলে যখন স্টার্ট দিল,তখন বাযে সন্ধ্যে সওয়া সাতটা। ছাড়তেই এত দেরি করল, তাহলে পৌঁছবে কখন? কলকাতায় ঢোকার টাইম তো সকাল সাড়ে ছটা, নিশ্চয়ই লেট করবে, আর তার মানে আমার বাড়ি ফিরতে আরও লেট হবে। বাস ঢুকবে ধর্মতলায় কিংবা করুণাময়ীতে, সেইখান থেকে বাস ধরে আমাকে আসতে হবে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি।

হিলকার্ট রোডের অকথ্য জ্যামের মধ্যে দিয়ে কোনওরকমে নড়েচড়ে বেরিয়ে বাস বেরিয়ে পড়ল ফাঁকা রাস্তায়। আর তার পরেই স্পিড তুলল। বাস টার্মিনাসে না হওয়া ঘুম আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার চোখে। কোনওরকমে ঘাড়টাকে একটু কাত করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সাড়ে তিনটেয় খেয়ে উঠেছি, ব্যাগে কেক বিস্কুট আর জল আছে, আশা করি রাতে আর খাবার দরকার হবে না। একেবারে বাড়ি পৌঁছে খাব।

রাতের বাসে ঘুম ভালো হবার কথা নয়, পেছন রোয়ের সীট বিশেষ হেলানোও যায় না; তাও প্রথম কয়েক ঘণ্টা মড়ার মতই ঘুমোলাম। মাঝে একবার ঘুম ছিঁড়ে গেল, দেখলাম সামনে ট্র্যাফিক জ্যাম, বাস আস্তে আস্তে এগোচ্ছে, দুদিকে লোকবসতি প্রায় নেই, গাছপালারই আধিক্য, তার মধ্যে ডানদিকের জানলা দিয়ে অল্প আলোয় দেখতে পেলাম একটা সাইনবোর্ড – শিলাবৃষ্টি ধাবা।

এমন কাব্যিক নাম ধাবার হতে পারে, আগে কখনও দেখি নি। কোথায় এলাম? মোবাইল খুলে ম্যাপ দেখে বুঝলাম দক্ষিণ দিনাজপুরের কোনও একটা জায়গা দিয়ে চলেছি, আর আমার বাঁদিকে, একদম রাস্তা লাগোয়া, বাংলাদেশের বর্ডার।

আমি বসে আছি বাসের ডানদিকে, সেখান থেকে বাঁদিকের জানলা দেখতে পাওয়া সোজা কথা নয়, তাও ঘাড় ঝুঁকিয়ে বাঁদিক দেখলাম। উজ্জ্বল আলো, কাঁটাতারের শক্তপোক্ত বেড়া, বেড়ার অন্যপারে ফাঁকা জমি, খুব দূরে কিছু ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ।

আমাদের ভাষা আলাদা, তাও একজন ভারতীয় হয়ে ভুটানে যাওয়া আসা করা আমাদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়, কিন্তু ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও আমরা এত সহজে বাংলাদেশ যেতে পারি না। দেশভাগের ক্ষত এতটাই গভীর।

শেষরাতে আবার ঘুম ভেঙে গেল, তখনও দিনের আলো ফোটে নি, বাস চলেছে এক সরু রাস্তা ধরে, দুদিকে অন্ধকারেও টের পাওয়া যাচ্ছে, ধানের ক্ষেত। জায়গাটা খুব চেনা চেনা লাগছে, কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি?

পকেট থেকে আবার মোবাইল বের করে ম্যাপ খুললাম। অন্ধকারের মধ্যে মোবাইলের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল একেবারে। চোখ সইয়ে নিয়ে লোকেশন দেখে তো আমি হাঁ – আমি চলেছি মঙ্গলকোটের মধ্যে দিয়ে। বর্ধমান? শিলিগুড়ি কলকাতার বাস এখন বর্ধমান দিয়ে আসছে? মাত্র দেড় বছর আগেই মোটরসাইকেল চালিয়ে আমি এই রাস্তা দিয়ে ফিরেছি, তাই এত চেনা চেনা লাগছিল, তার মানে বাস যাবে বর্ধমান শহরের মধ্যে দিয়ে, সেখান থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরবে? এখন তাহলে আর কৃষ্ণনগর বহরমপুরের রাস্তা ধরে আসে না এনবিএসটিসির বাস?

মঙ্গলকোট পেরোতে পেরোতেই হাল্কা করে দিনের আলো ফুটল, প্রথমেই চোখে পড়ল ধানক্ষেতের মধ্যে তৃণমূলের একটা আধভাঙা পার্টি অফিস, সেইখানে কেউ বা কারা গতকালই খুব বড় করে অনুব্রত মণ্ডলের জন্মদিন পালন করেছে। অনুব্রতর একটা বড়সড় ছবি, তৃণমূলের পতাকা তোলা একটা স্ট্যান্ডের গায়ে হেলান দিয়ে লাগানো, চারদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে ফুল।

বীরপূজা।

বর্ধমান যখন আর প্রায় কুড়ি কিলোমিটার বাকি, লোকজন মোটামুটি উঠে বসেছে নিজের নিজের সীটে, কন্ডাক্টর এসে বলে গেল, বাস বর্ধমান স্টেশনের পাশ দিয়ে যাবে, কারুর যদি বর্ধমানে নামার থাকে নেমে যেতে পারে।

হাতে চাঁদ পেলাম। বর্ধমানে নেমে ট্রেন ধরলে আমি অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে যেতে পারব।

ঠিক ভোর ছটায় বর্ধমান স্টেশনের সামনেটাতে বাস এসে দাঁড়াল,আমি নেমে পড়লাম, এবং সোজা টিকিট কাউন্টারের সামনে লাগানো বোর্ডের কাছে গিয়ে দেখলাম ছটা পঁয়ত্রিশে একটা চমৎকার গ্যালপিং বর্ধমান হাওড়া লোকাল আছে, যার বর্ধমান আর হাওড়ার মাঝে একটাই মাত্র স্টপেজ – ব্যান্ডেল। এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিটে ব্যান্ডেল ঢোকাবে। আমিও গ্যালপ করতে করতে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে পৌঁছলাম এবং সময়মতই ট্রেনও ছেড়ে দিল।

যেখানে ভাবছিলাম বেলা এগারোটা না বারোটা বাজবে বাড়ি ঢুকতে, সেখানে ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে যখন বেরোলাম, তখন বাজছিল পৌনে আটটা মাত্র।




এর পর?

এর পর আর বিশেষ কিছু লেখার থাকে না, এ লেখা আর বেশিদূর টেনে নিয়ে যাবার আর মানেও হয় না, তবে এটুকু লিখে রাখতেই পারি, এবারের ব্যান্ডেল দেখে আমার অপরিসীম দূঃখ হল, আতঙ্ক হল।

না, একটা দেওয়ালেরও দখল নেয় নি বিজেপি, বিজেপি দেওয়াল লিখনের সংস্কৃতিতে দক্ষ নয়, সেখানে এখনও তৃণমূল আর সিপিএমেরই নাম, কিন্তু স্টেশন চত্বর থেকে প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি দোকানে, প্রতিটি বাঁকে দেখতে পেলাম তিনকোণা গেরুয়া পতাকা, যাতে হিন্দিতে লেখা জয় শ্রীরাম বা জয় হনুমান; আর বিজেপির পার্টি ফ্ল্যাগ। সর্বত্র ছেয়ে গেছে ফ্যাসিস্টের দল, প্রকট উপস্থিতি তাদের হুগলির অলিতে গলিতে, রাস্তার দুই ধারে।

এটুকু লিখে রাখাই যায়, বালির মোড় দিয়ে আমি যখন ফ্রেন্ডস লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছিলাম, খেয়াল করলাম আমার এক পরিচিত পাড়াতুতো জেঠু কার সঙ্গে যেন ধাপিতে বসে লুঙ্গি গুটিয়ে উচ্চৈঃস্বরে আড্ডা মারছেন, আরে – বলে কিনা জয় শ্রীরাম বলা যাবে না। কেন যাবে না শুনি? জয় শ্রীরাম বললে কী ক্ষতি হয়? মমতার মাইরি যত্তো ইয়ে …

বুড়ো লোকটি আমাকে চিনবেন, ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, ঝট করে মনে হচ্ছিল সামনে গিয়ে বলি, ওরে বোকাচোদা, ওরে হিন্দুচোদা বাঞ্চোৎ, উনিশশো বিরানব্বই সালে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তুই শালা তখন এক মেয়ের বাপ ছিলিস। দু হাজার দুই সালে তুই আরও বড় কাপ্তান ছিলিস পাড়ার, আমার থেকে তোর বেশি মনে থাকার কথা জয় শ্রীরাম বলার পরে কী কী হয়েছিল, কী কী হতে পারে। বালির মোড়ে বসে লুঙ্গি তুলে লোমশ থাই চুলকে জগৎ উদ্ধার করে করেই তো জীবনটা কাটিয়ে দিলি গাণ্ডুচোদা, তুই জানবি কী করে জয় শ্রীরাম শ্লোগান আর গেরুয়া পতাকার আঘাতে দেশজুড়ে কত নিরীহ লোকের প্রাণ গেছে। এই যে সকাল হলেই চকবাজারে গিয়ে কানকো তুলে মাছের দরদাম করিস, রোববারে গিয়ে রফিকের কাছে গিয়ে জ্যান্ত মুরগী কাটিয়ে আনিস কি পাঁঠার রান পছন্দ করে কিনে আনিস, তোর পেয়ারের জয় শ্রীরাম পার্টি একবার এ রাজ্যের ক্ষমতায় এলে ঐ মাছ মাংস তোর গাঁড়ে ঢুকিয়ে তোকে ডিটেনশন সেন্টারে ঢোকাবে বউ সমেত, বাঁড়া। নিজের কাগজপত্তরের তো কোনও হিসেব রাখিস নি, যেদিন এনআরসি চালু হবে এ রাজ্যে, সবার আগে তোকেই তুলবে ফ্যাসিস্টের দল, তোর জয় শ্রীরামের পেরেম তোর লুঙ্গির তলা দিয়ে তখন ছ্যারছ্যার করে গড়িয়ে পড়বে, শালা গেরুয়াচোদা। মিলিয়ে নিস সেদিন।

নাঃ, এসবের কিছুই বলি নি। আমি খুব শান্ত মাথার ভদ্র পাবলিক কিনা, তাই মনের সব ভাব প্রকাশ করি না। চুপচাপ পেরিয়ে গেছিলাম, শেঠেদের দোকান থেকে পোস্ত কিনে বাড়ি ফিরেছিলাম।

পরদিন ফেরার ট্রেন। রাজধানী এক্সপ্রেস। ট্রেন লেট করা ছাড়া আর কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল না ফেরার পথে।

যেটুকু না লিখলে এই লেখা শেষ করা যায় না, সেটা হচ্ছে, আলিপুরদুয়ারের সেই বি মজুমদার আর মিউনিসিপ্যালিটির সঞ্জয়বাবু রীতিমত যত্ন নিয়ে পরের কাজগুলো করে দিয়েছিলেন। ঠিক দু সপ্তাহের মাথায় আমার মোবাইলে সঞ্জয়বাবুর ফোন এল, আপনার বার্থ সার্টিফিকেট আমার কাছে এসে গেছে সই হয়ে – এখন বলেন কেমন করে দিল্লিতে আপনার কাছে পাঠাই। সাথে সাথে স্বরাজকে ফোন করলাম, এবং সে-ও খুব তড়িঘড়ি করে সেটাকে কুরিয়ার করে দিল। তিন সপ্তাহের মাথায় দিল্লিতে আমার হাতে পৌঁছে গেছিল আমার জন্মের প্রমাণপত্র।

(শেষ)


1 thoughts on “প্রমাণপত্রের জন্ম এবং সর্ষেদানারা – পর্ব ৫

  1. আপনার লেখা পড়ে দুটো বই কিনতে প্রায় বাধ্য হয়েছিলাম। সে অনেক বছর আগে। বশরাত পীরের “কার্ফিউড নাইট” , রাহুল পন্ডিতের “মাই মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস।” ১৯৯০ কাশ্মীর। বই দুটো আজও ভাবায়। আমার একটা লেখায় আপনার উল্লেখ করে রাহুল পন্ডিতের লেখা থেকে বাংলা অনুবাদে উদ্ধৃতি দিই। আমার ভীষণ ভালো লাগা একটা প্যারাগ্রাফ। একজন পাঠক জানালেন রাহুল নাকি এখন বদলে গেছেন।
    আপনার লেখা চমৎকৃত করে।
    ভালো থাকবেন। আরো কিছু র প্রত্যাশা আপনার কাছে – প্রীত্যন্তে

    Liked by 1 person

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.