জলু – তৃতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্বের পর

র‌্যাগিং নিয়ে অল্পবিস্তর চেঁচামেচি তখন প্রায় প্রত্যেক বছরই হত, তবে সেই নব্বইয়ের দশকে ব্যাপারটা খুব একটা উচ্চগ্রামে হত না। ফলে সিনিয়ররা, যারা মূলত র‌্যাগিং করত, তারা ব্যাপারটা বেশ খুল্লমখুল্লাই করত। প্রফেসররাও তাকিয়ে দেখতেন না, নাম-কা-ওয়াস্তে একটা অ্যান্টি-র‌্যাগিং কমিটি বানিয়ে তাঁরা দায় সারতেন। সেই অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটিতে থাকত কলেজের জি এস এবং আরও কিছু টপার গোত্রের ছেলে। বাকি আম আদমির সেই কমিটিতে কোনও এন্ট্রি ছিল না, কোনও say ও ছিল না, ফলে খুব আরামসে জিএস স্বয়ং এবং অন্যান্য অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটির ছাত্ররাও র‌্যাগিং করতে বসে পড়ত দল বেঁধে।

ব্যাপারটা যত সহজে বলে ফেললাম, ততটা সরলীকৃত করে ফেলাও বোধ হয় উচিত হবে না। জিএস বা টপারমাত্রেই র‍্যাগিং করত, এমনটা নয়, তবে আর সব কলেজের খবর জানি না, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে চার বছরে যতটা দেখেছি, র‌্যাগিং হত ভালো রকমই, কিন্তু সব সিনিয়র র‌্যাগিং করত না, বা তার মধ্যে থাকতই না।

‘সিনিয়র’দের প্রধানত কয়েক রকমের ক্যাটেগরি ছিল। প্রথমেই বাদ দেওয়া যায় ফোর্থ ইয়ারকে। ফোর্থ ইয়ারের থাকত আলাদা হস্টেল, ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের সব চেয়ে ক্রুশিয়াল ইয়ার কিনা! পড়ার চাপ বেশি, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, তার বাইরেও চাকরির চেষ্টা, গেট বা ক্যাট বা জিআরইর জন্য আলাদা প্রিপারেশন তাদের এত ব্যস্ত রাখত যে তারা সাধারণত র‌্যাগিংয়ে সামিল হত না। সাধারণত বলছি এই কারণে, যে কিছু অত্যুৎসাহী অবশ্যই থাকত যারা র‌্যাগিং করতে ফার্স্ট ইয়ারের রুমে রুমে হানা দিত, কিন্তু তাদের সংখ্যা ফোর্থ ইয়ারে খুবই নগণ্য, ইগনোর করা যায়।

র‌্যাগিংয়ে মূলত ইনভল্‌ভড থাকত সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ার। এদের মধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের ইনভল্‌ভমেন্ট ছিল বেশি। প্রথম সিনিয়র হবার স্বাদ পাওয়া এই র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমেই।

এবং, আবারও, সরলীকরণ হবার আগেই বলে দিই, সেকেন্ড ইয়ার বা থার্ড ইয়ারের ছাত্র মাত্রেই র‌্যাগিং করত, এমন বলা নাথিং বাট অনৃতভাষণ হবে। সব ইয়ারেই এক ধরণের ছেলে থাকত যারা কাউকে মেরে আনন্দ পেত। মেরে, বা ভয় দেখিয়ে, বা যৌন উত্তেজনামূলক কার্যকলাপ করিয়ে। এই সব কাজ প্রতিবাদহীনভাবে করানোর জন্য সব থেকে সফ্‌ট টার্গেট ছিল মূলত ফ্রেশাররাই, ফার্স্ট ইয়ার। এরা বড় বড় ‘টি’ (ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রয়িং করার জন্য এক রকমের বড় T শেপের স্কেল) বা ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াত, মুখে অশ্রাব্য খিস্তি, দুই হাতে পায়ে বইত লাথি চড় থাপ্পড়ের বন্যা। এদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলেপুলেই ছিল পার্সোনালিটিলেস্‌, সারা বছর নিজের ইয়ারের ছেলেপুলেদের মধ্যে কোনওরকম পাত্তা পেত না, অথচ পাত্তা পাবার, সম্মান পাবার একটা উদগ্র আকাঙ্খা তাদের মধ্যে কাজ করত, তারাই প্রধানত র‌্যাগিংয়ে সবচেয়ে বেশি অ্যাকটিভ রোল নিত। ঐ কটা দিনের জন্য তারা ফ্রেশার নামক কিছু অসহায় মুরগীদের কাছ থেকে গায়ের জোরে সম্মান আদায় করে নিত।

এ জিনিস যে কোনও জনগোষ্ঠীতে হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ভালো লোক প্রতিবাদ করে না বলেই সামান্য কয়েকজন খারাপ লোক পাড়াকে, রাজ্যকে, দেশকে ভয় পাইয়ে রাখে। সে হাতকাটা কাত্তিকই হোক বা যোগী আদিত্যনাথ।

আরেক ধরণের ছেলে ছিল, একেবারে সেই আজকের দিনের ‘বারান্দা থেকে আমি নামি না’ প্রজাতি, সাতেও থাকত না, পাঁচেও থাকত না। র‌্যাগিং হল-কি-না-হল, কে তাকে পাত্তা দিল-কি-না-দিল, তাতে তাদের সিম্পলি ছেঁড়া যেত। তারা নিজেদের রুমের মধ্যে বিছানায় দিনভর উপুড় হয়ে (হস্টেলের ভাষায় ‘পোঁদ উল্টে’) ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিকস, বা ইলেকট্রিকাল মেশিনস বা অন্য কিছু পড়ে যেত, পড়েই যেত। জগতের বাকি সবকিছু সম্বন্ধে একেবারে নিরুৎসাহী, একদম ডিটাচড।

এই দু ধরণের ছেলেদের মাঝে আরেক ধরণের সিনিয়র থাকত, যারা ছিল মধ্যপন্থী। মারধোরের মত ব্যাপারে এরা বিশ্বাস করত না, কিন্তু জাস্ট ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সঙ্গে পরিচিত হবার তাগিদে এরা চলে আসত ফার্স্ট ইয়ারের হস্টেলে, ‘তোর কটা বোন’ বা ‘দিনে কবার খিঁচিস’ টাইপের বোকা বোকা কোশ্চেন বা মারধোরের বদলে এরা তাদের খুঁজে বের করত যারা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে চৌখস। কে গান করে, কে ভাল এক্সটেম্পোর দেয়, কে ভালো ডিবেট করতে পারে, কার কুইজে প্রচুর প্রাইজ আছে, কে ক্যারিকেচার করতে পারে, এই রকম ছেলেদের খুঁজেপেতে তুলে আনত নিজেদের হস্টেলের রুমে, পুরো র‌্যাগিং পিরিয়ড জুড়ে এই সব ফ্রেশারদের এরা শেল্টার দিত নিজেদের রুমে, বিছানা শেয়ার করত, র‍্যাগিংয়ের কদিন এদের মেসে নামতে দিত না, মেস থেকে এদের জন্য খাবারের প্লেট তুলে আনত, মারকুটের দল হাতের সুখ করার জন্য যদি এদের ঘরে হানা দিত ফ্রেশারের খোঁজে, এই সিনিয়ররা তখন আশ্রিত ছেলেগুলোর ওপর প্রচন্ড বকাঝকা হম্বিতম্বি, এই মারব কি সেই মারব টাইপের অভিনয় করত, মানে একটা ক্যামুফ্লাজ তৈরি করত যাতে করে র‍্যাগিং করনেওয়ালারা মনে করত এই ‘ছানা’গুলো অলরেডি প্রচন্ড ক্যাল খাচ্ছে, আর এদের আলাদা করে মারার দরকার নেই, এই ভেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অন্য ছানার খোঁজে সরে যেত। ইন্টেলেকচুয়াল না হলেও ক্ষতি ছিল না, এমনিই কাউকে পছন্দ হয়ে গেলে এই ধরণের ছেলেরা ছানাদের এইভাবেই শেল্টার দিত।

ছানা। এই নামেই পরিচিত হত সমগ্র ফার্স্ট ইয়ার। ইহা জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ স্পেশাল। বিভিন্ন ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে এর বিভিন্ন নামকরণ হয়ে থাকে। শিবপুর বিই কলেজে এদের মুরগী বলে ডাকা হত, দুর্গাপুরে বোধ হয় জুনি … ঠিক বললাম কি? যেকোনও ফার্স্ট ইয়ারকেই ছানা বলে ডাকার অধিকার ছিল যে কোনও সিনিয়রের, মেয়ে হলে ছানি।

এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আরেকটা শব্দ। পোনা, লিঙ্গভেদে  পুনি। বোঝাই যাচ্ছে এটা সিনিয়রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ছানার মত ব্যাপকার্থে নয়। এটা হত এলাকাতুতো দাদা / দিদির ক্ষেত্রে। যেমন আমি ব্যান্ডেল থেকে এসেছি, ব্যান্ডেলের ছেলে সঞ্জয়দা, আমার সিনিয়র, আমার এলাকাতুতো দাদা। তাই সঞ্জয়দা আমার পোনা। আমার এক পুনিও হয়েছিল, অর্পিতাদি, তাকে অবশ্য আমি অনেক পরে চিনেছি, জলপাইগুড়ি আসার আগে চিনতাম না। সাধারণভাবে পোনা তার ছানার ওপর র‌্যাগ করত না, বরং শেল্টার দেবারই চেষ্টা করত। যে হেতু বেশির ভাগ ছেলেপুলে কলকাতা থেকে এসে থাকে, তাই কলকাতার মত বড় জায়গার ক্ষেত্রে এই পোনা ঠিক হত ছোট এলাকা বা স্কুল ধরে, যেমন দমদম মতিঝিল কিংবা সেন্ট জেভিয়ার্স-তুতো দাদা।

র‌্যাগিং কী রকম হত? আমি নিজে র‌্যাগিং পিরিয়ডের শেষে পৌঁছেছি, র‌্যাগড হবার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই, সমস্তই বন্ধুদের মধ্যে শোনা। কিছু র‌্যাগিংয়ের বিষয়বস্তু সকল কলেজের ক্ষেত্রেই এক, যেমন ফুঁ-বল খেলা। একটা ঘরের মধ্যে কাগজের গোলা পাকিয়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেলতে হবে, যে গোলকিপার, তাকেও ফুঁ দিয়ে সেই বল আটকাতে হবে। এর পরে ক্যালেন্ডার হতে হত, দেয়ালের থেকে বেরিয়ে আসা লকারের ছাদ ধরে ক্যালেন্ডার হয়ে ঝুলতে হবে, হাওয়া দিলে ক্যালেন্ডার যেমন করে দোলে, তেমন করে দুলতেও হবে।

সার্কিট করাঃ ঘরে যত ফার্নিচার আছে, চারটে খাট, তিনটে টেবিল, তিনটে চেয়ার, সবকটার নিচ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে হবে, কোনও ফার্নিচার এর জন্য উল্টে গেলে, চেয়ারের ক্ষেত্রে যা হামেশাই হত, ছানার গালে পিঠে পড়ত চড় থাপ্পড়।

এর পর হত ইনভার্স। জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ করে, উল্টো অর্ডারে পরাঃ প্রথমে জামা, তার ওপর গেঞ্জি, প্রথমে প্যান্ট, তার ওপরে শর্টপ্যান্ট / জাঙ্গিয়া। খালি পায়ে জুতো পরে তার ওপর দিয়ে মোজা পরা। হয়ে গেলে পরে সেই সাজে করিডর দিয়ে ঘুরিয়ে আনা।

পরে অর্ধেক গোঁফ কামিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে আনাও দেখেছি।

এর পর ছিল সুইসাইড নোট লেখানোঃ তোকে এখানে এত মার দেওয়া হবে, তুই মরেও যেতে পারিস, আগে একটা চিঠি লিখে যা, সুইসাইড নোট, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়। মৃত্যুভয়ে ভীত ছানার হাউমাউ কান্নায় উল্লসিত হয়ে উঠত র‌্যাগারের দল, কারণ একমাত্র তারাই জানত এখানে কাউকে মেরে ফেলা হয় না। (মেরে ফেলতে কে-ই বা চায়, নব্বইয়ের দশকেই আইআইটি খড়গপুরে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল, তাকে তিনতলার কার্নিস দিয়ে হাঁটানো হচ্ছিল ‘মজা করার জন্য’)

সুইসাইড নোট লেখার পর তাকে খেতে দেওয়া হত ব্রাউন শুগার। মূলত গ্রাম বা শহরতলি থেকে আসা ছেলেরা এই সময়ে প্রচন্ড কান্নাকাটি, হাতে পায়ে ধরা, এইসব করত। তারা ম্যাক্সিমাম সিগারেট খেয়েছে, বিড়ি খেয়েছে, এখানে এসে র‌্যাগিং পিরিয়ডে যে ব্রাউন শুগারের মত ভয়ঙ্কর জিনিস খেতে দেওয়া হবে, এ তাদের স্বপ্নের অতীত। সে জিনিস তারা চোখেও দ্যাখে নি, শুধু জানে এ ভয়ঙ্কর নেশা। তারা কিছুতেই খাবে না, আর তাদের খাওয়ানো হবেই।

র‌্যাগিং পিরিয়ডে, এই ব্রাউন শুগার জিনিসটা ছিল কমপ্ল্যান আর চিনির একটা মিক্সচার। সত্যিকারের ব্রাউন শুগার যে আসলে কমপ্ল্যানের মত ব্রাউন রংয়ের আদৌ দেখতে হয় না, সেটা জানার কথা নয় সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে আসা ছানাদের। কেবল তাদের ভীত মুখগুলো আর রিয়্যাকশন দেখার জন্যে এই ধরণের মজা করা হত।

এই ধরণের বিভিন্ন প্রকার “ইন্টার‍্যাকশন”-এর মধ্যে দিয়েই ছানাদের নামকরণও করা হত, যে নাম তাদের থেকে যায় কলেজজীবন শেষ হয়ে চাকরিজীবনের শেষদিন পর্যন্ত, যতদিন কলেজের বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক থাকে। খুব কান্নাকাটি করা ছেলের নাম হত কেঁদো, মেয়েলি স্বভাবের ছেলের নাম হত মাগি বা বৌদি বা পিসিমা। এমনি করেই গামছা, কেতু, পেড্রো, অমলেট, ম্যাক্স, পানু, দুদু ইত্যপ্রকার অসংখ্য নামে ভূষিত হত ছানার দল।

র‌্যাগিং হস্টেলের ভেতরে যেখানে যতখুশি হোক, দুটো জায়গা বাদ দিয়ে হত। এক, মেস, আর দুই, কমন রুম। হস্টেলের ছেলেপুলে স্বভাবতই উচ্ছৃঙ্খল হয়, কিন্তু দু একটি নিয়ম সকলে মেনে চলত, নিয়ম করে, সেটা হল; এই দুই জায়গায় প্রবেশ করতে হবে জামা পরে। খালি গায়ে বা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ঢোকা যাবে না। আর এই দুই জায়গায় কোনও র‌্যাগিং হবে না।

তবে মেসে কিছুটা হত, হাতা উলটো করে ডাল তুলতে হবে, ভাত তুলতে হবে গোছের আবদার। যা একেবারেই অসম্ভব। কেউই পারত না, তখন ছানার মাথায় চাঁটি ফ্রি-তে মেরে তার পাতে এক খাবলা আলুভাজা আর ডিম তুলে দিয়ে বলা, নে, খেয়ে নে। মেসের ভেতর ছানাদের বেশ যত্ন করে খাওয়ানো হত। আমি খুব ধীরেসুস্থে খেতাম, হস্টেলে আসার আগে প্রচুর শুনে এসেছি, তাড়াতাড়ি খেতে শেখ, হস্টেলে গিয়ে এই রকম আস্তে আস্তে খেলে কিন্তু বন্ধুরা সব কেড়েকুড়ে খেয়ে নেবে, নিজের পেটে কিচ্ছু যাবে না। আদতে হস্টেলে এই রকমের কোনও ঘটনা কখনও ঘটত না। খাওয়া নিয়ে কেউ কোনও রকম অমানবিকতা করত না, সে যত বড় র‌্যাগারই হোক না কেন। বন্ধুরা তো দূরের কথা, সিনিয়ররা পর্যন্ত কোনওদিন ছানার পাত থেকে খাবার কেড়েকুড়ে খায় নি, বরং ছানার পাতে এই ভাবেই তুলে দিয়েছে তরকারি, আলুভাজা। খাওয়া শেষ হলে ঘরে নিয়ে গিয়ে আবার র‌্যাগ করা যেত। চাইলে তেমন মনপসন্দ ছানা হলে তাকে একটু ভাতঘুম দিয়ে নেবার পারমিশনও দেওয়া হত।

র‌্যাগিংয়ের আরও প্রকৃতি ছিল। বাংলা পানু বই, চণ্ডীপাঠের সাথে মিলিয়ে যাকে পুন্ডি বলা হত, সেই সব পাঠ করানো, এবং প্রতিটা শব্দের মধ্যে কিছু আদিরসাত্মক শব্দ গুঁজে গুঁজে দেওয়া। প্রচন্ড হাস্যকর লাগত শুনতে, কিন্তু হাসলেই মার। এ এক নেভারএন্ডিং লিস্ট। কাপড় কাচানো হত, জাঙ্গিয়া কাচানো হত ছানাদের দিয়ে। কিংবা, ম্যাকডাওয়েলসের ক্যালেন্ডারে পামেলা অ্যান্ডারসনকে যদি লম্বালম্বি মাঝ বরাবর ভাঁজ করা যায়, তা হলে সেই ভাঁজটা পামেলার কোন কোন অঙ্গ দিয়ে যাবে, তার ডিটেল্‌স বর্ণনা। আর ছিল কিছু জামাইঠকানো প্রশ্ন, তোর কটা বোন, তোর জামায় কটা বোতাম, তোর এইচএসের নাম্বারকে এ টু দি পাওয়ার বি প্লাস বি টু দি পাওয়ার এ ফর্মে প্রকাশ কর।

আরও অলিখিত নিয়ম ছিল। সিনিয়র এসে দাঁড়ালে ছানাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। হাসলে চলবে না, যতই ভার্চুয়াল কাতুকুতু দেওয়া হোক না কেন। জামার কলারের বোতাম, হাতার বোতাম, সমস্ত বোতাম ঠিকভাবে আটকানো থাকবে। ঘড়ি পরা চলবে না।

চার থেকে পাঁচ দিন চলত এই উৎসব। শেষ দিন হত মাস্‌ র‌্যাগিং। সেদিন মহোৎসব। সে দিন সমস্ত অ্যাক্টিভ র‌্যাগাররা দলবদ্ধভাবে ছানাদের নিয়ে যেত কলেজ ক্যাম্পাসের পেছনের মাঠ পেরিয়ে চা বাগানে। ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান। সাধারণত কলেজে অ্যাডমিশন হত আগস্ট মাসে, তখন তরাইতে ভরা বর্ষা। ফলে এক আর দু নম্বর হস্টেলের পেছনের মাঠ থাকত সম্পূর্ণ কাদা-পাঁকে ভরা। সেই পাঁকে ছানা পোনা সকলে মিলে সকলকে কাদা পাঁক মাখানো হত, মূলত ছানাদেরই মাখানো হত। কাদা মেখে যখন সবাই ভূত, কাউকে দেখে চেনার উপায় নেই, তখন জামাপ্যান্ট খুলে কেবল মাত্র জাঙিয়া সম্বল করে, চা বাগানের ভেতর দৌড়। সর্বাঙ্গে কাদা থাকায় আলাদা করে চেনার উপায় থাকত না কার পরনে জাঙিয়া আছে, কার পরণে কিছুই নেই। হুল্লোড় হইচইতে ভরে যেত নিস্তব্ধ চা বাগান। চা-পাতা তোলা মদেশিয়া কামিনের দল সেদিন ধারেকাছে ঘেঁষত না।

কলেজের পেছনে চা-বাগান, তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। বাকি ভারতের সঙ্গে উত্তরপূর্বকে সংযুক্ত করার একমাত্র লাইন – নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গুয়াহাটির দিকে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র মেল।

দৌড় চলত রেললাইন পর্যন্ত। চা বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আসামের দিকে। সেখানে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হঠাৎ শেষ হয়ে যেত র‌্যাগিং। এতক্ষণ নির্মম ব্যবহার করে আসা সিনিয়রের দল হঠাৎ করে লাঠি টি সমস্ত ফেলে দিয়ে উদ্দাম উল্লাসে ছানাদের বুকে জড়িয়ে ধরে ওয়েলকাম জানাত, সবাই যে যার জামাপ্যান্ট ফেরৎ পেত। সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হত ছানাদের। এখন থেকে তারাও এই ক্যাম্পাসের অংশ। হাসতে পারে, খেলতে পারে, সিনিয়রদের দেখে আর দাঁড়াবার দরকার নেই, নো ফর্মালিটিজ, হস্টেলে ফিরে পাঁচদিন বাদে সেই প্রথম ছানারা চান করত অফিসিয়ালি। সমস্ত কাদা ময়লা দূর করে পরিস্কার হয়ে সবাই জড়ো হত কমন রুমে। র‌্যাগিং পিরিয়ডের শেষে ছানাদের সেই প্রথম কমন রুমে প্রবেশাধিকার। রঙিন শিকলিতে ততক্ষণে কারা যেন সাজিয়ে ফেলেছে কমন রুম, সারি সারি বালতির পর বালতি ভর্তি রস্‌না, কিসানের স্কোয়াশ অথবা বাংলা। কাপ ডোবাও আর খাও। টেবিল উপচানো লজেন্স, যত খুশি খাও, চড়া ভল্যুমে বাজছে গান, সবাই নাচছে। পাঁচদিনের দমবন্ধ করা টেনশন থেকে হঠাৎ মুক্তি পেয়ে ফ্রেশারের দল তখন প্রায় পাগলের মত হয়ে যেত। সিনিয়রের কাঁধে হাত রাখতেও তখন আর কোনও মানা নেই, কিশোর কুমারের গানের সাথে এক সাথে কোমর জড়িয়ে নাচ, গান, হুল্লোড় … এর মধ্যেই এক ফাঁকে হয়ে যেত ফ্রেশারদের মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ, সাথে একটা করে গোলাপফুলের স্টিক। সন্ধ্যের পর থেকে শুরু হত মদের ঢালাও আসর। যারা এর আগে কোনওদিন মদ্যপান করে নি, তারাও এই হঠাৎ মুক্তির আনন্দে গলা ভিজিয়ে নিত।

এই যে এতখানি বিবরণ দিলাম, পুরোটাই বন্ধুদের মুখে শুনে এবং পরবর্তী বছরে নিজের চোখে দেখে। মেয়েদের হস্টেলেও শুনেছি র‍্যাগিং হত, সে কী জিনিস হত, কখনও জানি নি, জানার চেষ্টাও করি নি। ফ্রেশার হিসেবে, এক্সেপশনালি, আমাকে এ সবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি, আগেই লিখেছি। ঘটনাচক্রে আমি এসে পৌঁছই এই ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হয়ে যাবার ঠিক পরের দিন। ফলে এর কিছুই আমাকে ফেস করতে হয় নি।

আজ এত বছর পরে, র‌্যাগিংয়ের এ পর্যন্ত দেওয়া সমস্ত বিবরণই আমি দিলাম নিছক উদাসীন বিবরণ হিসেবে, নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে র‌্যাগিংয়ের সমর্থক নই, ছিলামও না, সময়ের সাথে সাথে, বয়েসের সাথে সাথে র‍্যাগিংয়ের নামে নোংরামোর বিরোধী হয়ে উঠেছি ক্রমশ, আর এখন তো শুনতে পাই র‍্যাগিং নাকি আর হয় না।  পরবর্তীকালে, সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ারে আমি ছিলাম সেই ধরণের সিনিয়র, যারা ছানাদের যথাসম্ভব শেল্টার বা প্রোটেকশন দেবার চেষ্টা করত। জীবনে কোনওদিন কারুর গায়ে হাত তুলি নি, মারা বা মার খেতে দেখা কোনওটাই আমার পোষায় না। প্রায় সমবয়েসি কিছু ছেলেকে উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখতেও আমার রুচিতে বেধেছে, সে দিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান যে, আমাকে র‌্যাগ্‌ড হতে হয় নি। পরবর্তীকালেও সেই বিশেষ সময়গুলোতে আমি কলেজে বা নিজের রুমে স্বেচ্ছাবন্দী থাকতাম, এই ধরণের যৌনউল্লাস থেকে নিজেকে দূরেই রেখেছি। এবং এইসব করেছি বলে আমি নিজেকে খুব গুড বয় বা ভালো ছেলে বলে তুলে ধরতেও চাইছি না, কারণ এই রকম মানসিকতার আমি একাই ছিলাম না, আমি সৌভাগ্যবান যে পরবর্তীকালে আমাদের ইয়ারের বা সিনিয়র ইয়ারের অধিকাংশ ছেলেকেই আমি এই মানসিকতার দেখেছিলাম। এই ধরণের নোংরামো করে খুবই কম সংখ্যক কিছু ছেলে। এবং ঠিক যেভাবে খুব কম সংখ্যক কিছু ক্রিমিনাল যেভাবে একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশের সম্পদ লুটেপুটে খায়, জনতার পয়সায় বিলাসব্যসন করে, কেউ কোনও প্রতিবাদও করে না, হস্টেলেও ঠিক সেই ভাবেই এই সামান্য কিছু সংখ্যক ছেলে নোংরামো করত, সংখ্যাগুরু জনতা তার প্রতিবাদও করত না।

আমিও করি নি।

এই চারপাঁচদিনের র‌্যাগিংয়ের স্মৃতিচারণা চলত হস্টেলজীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সময়ে, অসময়ে। নিজেদের মধ্যে, এমনকি সেই সব সিনিয়রের সাথেই, যারা এক দিন র‌্যাগিং করেছিল। ‘মনে আছে প্রতীকদা, আমি সেই বারবার হেসে ফেলছিলাম বলে তুমি আমায় কী জোরে চাঁটিটাই না মেরেছিলে?’ প্রতীকদা হয় তো তখন সামনেই পাত্তর নিয়ে বসে আছে, আধা তূরীয় অবস্থা, দিল দরাজ, সে তখন একদা র‌্যাগ করা ছানাকে আওয়াজ দিল, ‘আব্বে শালা এখনও খার খেয়ে বসে আছিস? এই নে, প্যান্টু খুলে দিচ্ছি, তুই শালা যতবার চাস আমার পোঁদে চাঁটি মেরে নে। শালা হস্টেল ছাড়ার দিন কলেজ মোড়ে মাস্‌ ক্যাল দিবি না তো তোদের ইয়ারের ছেলেরা মিলে? সেদিন শালা তোদের ফুটবল টিমের হয়ে গুচ্ছ চেঁচিয়েছি, সেটা ভুলে গেলি বালটা?’

প্রায় নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই পুরনো রাগগুলো এইভাবেই ডাইলিউট হয়ে যেত, হস্টেল ছাড়ার দিন পর্যন্ত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। আমি অন্তত কাউকে দেখি নি শেষদিন পর্যন্ত মার খাওয়ার জন্য কোনও সিনিয়রের ওপর এই ভাবে রাগ পুষে রাখতে। এত গভীর সম্পর্ক হয়ে যেত তাদের মধ্যে, জুনিয়রদের যে কোনও বিপদ আপদে এই সব মারকুটে ছেলের দলই সবার আগে দল বেঁধে এগিয়ে যেত , আমি বরাবর দেখেছি। টকমিষ্টি রিলেশনশিপ। যে দাদা যত মেরেছে, সেই দাদাই ক্লাস শুরু হবার আগে মার খাওয়া ছানার জন্য লাইব্রেরি থেকে আগেভাগে তুলে রাখত টিমোশেঙ্কোর ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিক্সের বই, অবহেলে দিয়ে দিত নিজের ড্রয়িং বোর্ড, টি। রাগ পুষে রাখা যেত না বেশিদিন। কারণে অকারণে ডাক পড়ত সেই দাদারই ঘরে, মাল খাবার আসরে। সিনিয়র জুনিয়রের পার্থক্যটা জাস্ট মুছে যেত কয়েক মাসের মধ্যেই। কেবল অমুকদা’ তমুকদা’ , নামের মধ্যে এই দাদা সম্বোধনটা ছাড়া আর কোনও তফাৎ থাকত না।

র‌্যাগিং আরেকটা কাজ খুব নিঃশব্দে করে দিত, সেটা হচ্ছে লেভেলিং। ইগো ধ্বংস করে দেওয়া। বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ছেলেপুলেরা পড়তে আসত। কলকাতার নিউ আলিপুরের পশ্‌ লোকালিটি থেকে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ছেলেপুলে, সকলেরই স্থান হত এই হস্টেলে, পাকেচক্রে এই রকম দুই মেরুর ছেলেদের রুমমেটও হতে হত, প্রাথমিকভাবে বনত না। ব্রেড স্যান্ডুইচের ঠিক পাশেই এক বাটি জলে ভেজানো মুড়ি আর দুটো কাঁচালঙ্কা, দুজনের চোখেই দুজনের ব্যবহার চূড়ান্ত অশ্লীল লাগত, কালচারাল কনফ্লিক্ট উপস্থিত হত। কিন্তু একই পংক্তিতে দুজনেই উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াবার পর, দুজনকে দিয়েই সিনিয়রের গেঞ্জি জাঙ্গিয়া কাচানোর পর, দুজনকেই ইনভার্স করানোর পর, দেখা যেত আর তাদের একসাথে এক ঘরে থাকতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তখন এ হয় তো ওকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে স্যান্ডুইচ খাওয়াচ্ছে, ও একে শেখাচ্ছে কী করে ঝাল সয়ে কাঁচালঙ্কায় কামড় লাগাতে হয়। দুটো ভীষণ আলাদা রকমের লেভেলকে এক লেভেলে নিয়ে আসার কাজটা করে দিত এই পাঁচদিনের র‌্যাগিং। সমস্ত রকমের ইগো, নাক উঁচু ভাব সব ধুয়েমুছে যেত। থেকেও যেত অনেক কিছু, কিন্তু অ্যাডজাস্টমেন্ট, কম্প্রোমাইজেশন, সহনশীলতা, এ সবের প্রথম পাঠ এর মাধ্যমেই হয়ে যেত, পাঁচদিনে। পদ্ধতিটা হয় তো বিজ্ঞানসম্মতভাবে এবং আইনসম্মতভাবে ঠিক নয়, কিন্তু এই পরিবর্তন ঘটে যাওয়া আমার নিজের চোখে দেখা।

সে যাই হোক, বাবা চলে যাবার পর প্রথম সন্ধ্যে। নিজের বেডে বসে রুমমেটদের সাথে অল্পস্বল্পভাবে আলাপ জমাচ্ছি, হঠাৎ একটা ছোট দল ঢুকল, সঙ্গে ফিসফাস, এই .. এই .. সিনিয়র সিনিয়র। যথারীতি বেজায় ঘাবড়ে গেছি। একটা চা-রংয়ের নাইট স্যুট পরে, গোলগোল চোখ, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজন এসে দাঁড়ালো আমার সামনে, এবং আমি আমার নবলব্ধ জ্ঞান রিকল্‌ করে সিনিয়রকে সম্মান দিতে উঠে দাঁড়ালাম।

সিনিয়র চোখ পাকিয়ে , মোটা গোঁফ আরও ফুলিয়ে আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল, তারপর বেজায় বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করল, ‘কলারের বোতাম আটকানো নেই কেন?’

আওয়াজেই প্রাণ উড়ে গেল। তড়িঘড়ি কলারের বোতাম আটকে নিতেই বাকিরা আর হাসি চেপে রাখতে পারল না। সম্মিলিত হাসির হররায় আমি জানলাম, আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি কোনও সিনিয়র নয়, আমাদেরই সাথে অ্যাডমিটেড হওয়া ফ্রেশার, কৌশিক কুন্ডু, ওরফে কেকে। এ বার আমিও হেসে ফেললাম, বন্ধুত্ব হয়ে গেল এক নিমেষে।

সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ার, দু বছর কে-কে ছিল আমার রুমমেট।


সাতদিন কাটল। সে দিন শনিবার। কলেজ দুপুরে ছুটি। ততদিনে উইংয়ের সমস্ত বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা, বিভিন্ন রকমের সব ছেলে। কত রকমের তাদের ডায়ালেক্ট, কত রকমের তাদের নিকনেম। একজন দিল্লির ছেলেও ছিল, তার পদবি জেটলি। নাম শুনেই হেসে ফেলেছিলাম, জেটলি আবার কী ধরণের পদবি? ছেলেটা বেশ হাসিখুশি ছিল। আমারও নিকনেম দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, নিকনেম ছাড়া তো কেউ হস্টেলে থাকতে পারে না, তো তার সুযোগ করে দিলাম আমিই। সন্ধ্যের আসরে গলা খুলে গেয়ে দিয়েছিলাম, পর পর দু দিন। তখন সুমন চাটুজ্জে আমার হট ফেভারিট। এ দিকে কলেজে সুমন তখনও ব্রাত্য, ছেলেপুলেদের রুমে বা কমন রুমে হিন্দি সিনেমার গান বা পুরনো দিনের বাংলা গানই মূলত বাজত, কেউই সুমন প্রতুল শুনত না। শোনালাম আমি। নচিকেতা তাও চলত, তাই জনতার দাবি মেটাতে নচিরও প্রচুর গান আমাকে গাইতে হয়েছিল। ফলে, আমার নামকরণ হল জীবনমুখী ছানা। শর্টে, জীমু, সেটা ক্রমশ পাল্টে হয়ে গেল জিনু। এখনও কলেজের বন্ধুরা আমাকে জিনু বলেই ডাকে।

তো, সে যাই হোক, আমার গানের সো-কলড প্রতিভা আমার অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ল ক্যাম্পাসে। আমাদের হস্টেলের দুই তিনতলায় থাকত থার্ড ইয়ার। একতলায় আমরা ফার্স্ট ইয়ার। মাঝে মাঝে থার্ড ইয়ারের কারুর ঘরে বসেও গান টান চলত। এ দিকে সেই সপ্তম দিনে, শনিবার বিকেলে কে একজন এসে আমাকে খবর দিল, এই, তোর নাম জিনু? তোকে ফোর্থ ইয়ার হস্টেলের ওমুকদা ডেকেছে। আজ সন্ধ্যেবেলায় একশো বারো নম্বর রুমে যাবি।

চিরকালীন ভিতু, আবার চোখে সর্ষেফুল দেখলাম। ফোর্থ ইয়ার মানে একটা দূর গ্রহের ব্যাপার, তারা নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে আমার র‌্যাগিং হয় নি, ফোর্থ ইয়ার আমাকে ডেকেছে মানে আমাকে নিশ্চয়ই ফেলে পেটাবে এ বার। শুনেছি র‌্যাগিং স্কিপ করলে ডবল র‌্যাগিং করা হয়।

রুমমেট অতীন, মধু, আর বৌদি মিলে যে যতরকম পারে ভয় দেখাল আমাকে, আর প্রচুর সহবৎ শেখাল, হাসবি না, কলারের বোতাম আটকে, বেল্ট আর ঘড়িটা খুলে যা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই মতো সেজেগুজে পুরো মুরগীর ছানা হয়ে সন্ধ্যেয় একা একা পৌঁছলাম ফোর্থ ইয়ারের হস্টেলে। উফ্‌ফ্‌, পুরো যেন বাঘের গুহা। সম্পূর্ণ অন্যরকম! এক আর দুই নম্বর হস্টেলের সাথে কোনওরকম মিল নেই! ভেতরে ঢুকে সব গোলকধাঁধা। কোথায় যে একশো বারো নম্বর রুম, খুঁজে বের করতে ঝাড়া কুড়ি মিনিট লাগল।

সেই ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ছ জন ফোর্থ ইয়ারের ছেলে।

… চলবে


12 thoughts on “জলু – তৃতীয় পর্ব

  1. “দাদ হাজা চুলকানিতে যে দেয় আরাম
    হাত কেটে সেও লেখে বর্ণালীর নাম”
    তুই র‍্যাগিং নিয়ে লিখেছিস, আর এটা বাদ পড়ে গেল? ওয়েলকামের পর তোর দয়ায় আবার র‍্যাগিং ফেরত এসে গেছিল।

    Like

        1. আজ্ঞে না, পুজোর ছুটির আগে, মোট সু সপ্তাহ ছিলাম। অনেক আগে কেটে পড়েছিলাম আমরা। আমি এসেছিলাম ছাব্বিশে আগস্ট, আর দশই সেপ্টেম্বর কেটে পড়েছিলাম পুজোর ছুটির নাম করে।

          Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.