দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১১

দশম পর্বের পরে

উনত্রিশে অক্টোবর, দশম দিন

ছোটবেলাটা আমার একেবারেই ছড়ানো-ছিটনো। তাই ছোটবেলার বন্ধু বলতে গেলে আমাকে আগে চোখ বুজে হাতে পেন্সিল নিয়ে ক্যালকুলেশন করতে হয়। বাবার ছিল বদলির চাকরি, ফলে এদিক সেদিক প্রাইমারি সেকেন্ডারি করতে করতে যখন ব্যান্ডেল সেন্ট জনসে এসে ঢুকেছিলাম, তখন সেটা হয়েছিল আমার পঞ্চম স্কুল। মাধ্যমিক দিয়ে বেরিয়েছিলাম এখান থেকে। এর পর উচ্চ মাধ্যমিক আরেকটা স্কুল থেকে, সব মিলিয়ে ছটা স্কুল জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমার “ছোটবেলা”।

শৌভিক আমার সেই সেন্ট জনসের বন্ধু। এর পরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ও আমার সাথে একসাথেই পড়ে, তার পরে আমাদের স্ট্রিম আলাদা আলাদা হয়ে যায়। স্কুল ছাড়ার পরে শৌভিকের সাথে বোধ হয় কখনও আর দেখা হয় নি, বেশ অনেক বছর পরে ফেসবুকের কল্যাণে আবার যোগাযোগ স্থাপন।

সকালে ঝটিতি হোয়াটসঅ্যাপের বার্তালাপে ঠিক হল, আমি সেভক ব্রিজ পেরিয়ে ওকে জানিয়ে দেব, মাদারিহাটের মোড়ে ও আমার জন্য অপেক্ষা করবে, একসাথে আমরা জয়গাঁও পর্যন্ত যাবো, সেখান থেকে ও ফিরে আসবে আবার।

জয়গাঁও এর আগে আমি দু বার গেছি, শেষ যাওয়া সেই উনিশশো আটানব্বই সালে, কলেজ থেকে, চুখা হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ছোট্ট গঞ্জ একটা, সামান্য কয়েকটা হোটেল, কিছু দোকান – এইসবই দেখেছিলাম, মনে আছে, আর ভুটান গেট পেরোলেই অন্য দেশ, অন্য রাষ্ট্র, সাজানো গোছানো। কোনও একটা মনাস্ট্রি দেখে এসেছিলাম, আর ফুয়েন্টশোলিংএর দিকে একটা ছোটো ক্রোকোডাইল প্রজেক্ট ছিল, সেখানে বেশ কিছু কুমীরছানা দেখে এসেছিলাম, আর সেই প্রজেক্টের পাশেই ছিল একটা সিনেমাহল, সেখানে তখন চলছিল গোবিন্দার সিনেমা ‘ছোটে সরকার’। … জয়গাঁও সম্বন্ধে এই আমার স্মৃতি।

সেই জয়গাঁওতে এখন পুলিশের ওসি আমার কলেজের বন্ধু স্বরাজ। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পুলিশের ওসি হয়েছে, এমন উদাহরণ আমি দেখি নি কখনও, তবে এককালে শুনেছি লোকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে ব্যাঙ্কের অফিসার হত। এও সেই রকমের কিছু হবে হয় তো।

স্বরাজের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল আগে থেকেই, সেই ফেসবুকেরই কল্যাণে। ও-ই আমাকে বলে রেখেছিল, তোকে থাকার ব্যাপারে কোনও চিন্তা করতে হবে না, জয়গাঁওতে এসে আমাকে একটা ফোন করিস শুধু। তা হতেই পারে – আমি গাজিয়াবাদের ওসি হলে আর স্বরাজ গাজিয়াবাদে বেড়াতে এলে আমিও ওকে এই রকমই কিছু বলতাম হয় তো – সেটা কথা না, কিন্তু স্বরাজকে মনে রাখা আর ওর কাছে ফিরে যাবার পেছনে আরও একটা বড় কারণ আছে।

গান।

আমাদের সময়ে হস্টেলে এক একটা উইংয়ের ছেলেদের মধ্যে যতটা ইউনিটি হত, এক উইংএর সাথে অন্য উইংয়ের খারাখারিও কম হত না। ব্যাপারটা দুয়েকবার মারামারির দিকেও এগোত। আমি অনেকদিন আগে “উত্তরবঙ্গ” নামে একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম গুরুচণ্ডা৯র পাতায়, সেটা আর শেষ করা হয়ে ওঠে নি, সেইখানে না বলা কিছু স্মৃতিকথার টুকরোটাকরা বরং এখানে লিখে ফেলি – এতদিন বাদে, আশা করি স্বরাজ যখন এই লেখা পড়বে, কিছু মনে করবে না আর।

আমি ছিলাম দোতলা ব্যাক উইংএর বাসিন্দা, আর স্বরাজ ছিল তিনতলা ব্যাক। এই দুটি উইংএর মধ্যে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না, বিশেষত, তিনতলা ব্যাকে কয়েকটি ইতর অমানুষ ছাত্র হিসেবে বাস করত। তারা টপার ছিল, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট মানুষ যখন বখে যায়, তখন সে যতটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তিনতলা ব্যাকের সেই ছেলেগুলো সেই লেভেলেরই বিপজ্জনক ছিল।

একটা উইংএ কুড়ি থেকে চব্বিশজন ছেলে থাকত, সবাই তো এক রকমের হয় না, কিন্তু মূলত ঐ কয়েকজনের জন্য আমি পারতপক্ষে তিনতলা ব্যাকের ছায়া মাড়াতাম না। গেলে যেতাম একজনের কাছেই। স্বরাজ।

তখন সেকেন্ড ইয়ার। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এসব কথা অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, কিন্তু পঁচানব্বই সালে জয়েন্টে চান্স পেয়ে যখন আমি জলপাইগুড়ি পৌঁছই, তখনও পর্যন্ত আমার বাড়ির ভাবধারা অনুযায়ী হিন্দি গান গাওয়া টাওয়া ছিল মোটামুটি বখে যাবার শেষ ধাপ। আমিও খুবই ভালোমানুষ টাইপের ছিলাম, ফলে জলপাইগুড়ি যাবার পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আঠেরো বছর বয়েস হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি কিশোরকুমার, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর বা মহম্মদ রফির একটা হিন্দি গানও শুনি নি।

স্বরাজের কাছে ছিল গানের ক্যাসেটের এক অবিশ্বাস্য কালেকশন। বাংলা, হিন্দি। আমি শুধু নয়, হস্টেলশুদ্ধ ছেলেপুলে স্বরাজের থেকে ক্যাসেট ধার নিয়ে যেত। স্বরাজের একটা মহাজনী খাতা ছিল, সেইখানে সে সব টুকে টুকে রাখত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – চাটুজ্জে, দশই ফেব্রুয়ারি, মহম্মদ রফির গোল্ডেন কালেকশন – সিকি, সতেরোই এপ্রিল। ঠিক সময়মত সে সেই ছেলেটির ঘরে গিয়ে ক্যাসেট ফেরত দেবার জন্য তাগাদা দিতে যেত। এই স্বরাজের দৌলতেই আমার প্রথম হিন্দি গানের স্টক তৈরি হয়। স্বরাজকে নিজেকে কোনওদিন গান গাইতে শুনি নি, খুবই মুখচোরা টাইপের ছেলে ছিল, খুব মৃদুস্বরে কথা বলত, রোগা পাতলা ফিনফিনে চেহারা।

সেই স্বরাজ কিনা এখন পুলিশ অফিসার, তাও ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ বর্ডার টাউনে। আর প্রস্থে সে এখন আমজাদ খানকেও ছাড়িয়ে গেছে, ফেসবুকে যা ছবিটবি দেখেছি। কী করে এমন মেটামরফোসিস হল, জানার খুবই ইচ্ছে, অতএব, সকাল সকাল রংপোতে হোটেলের পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

গেট থেকে বেরিয়ে একশো মিটার এগোতেই ঢুকে পড়লাম কালিম্পংএ – পশ্চিমবঙ্গ। এখান থেকে সেভক ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা একই, যে রাস্তায় এসেছিলাম। মাঝে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে পরোটা আলুচচ্চড়ি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম।

সাড়ে নটায় সেভক ব্রিজ। এসেছিলাম এক পাশের রাস্তা দিয়ে, ব্রিজের ওপরে উঠতে হয় নি, সেই রাস্তা সোজা চলে যাচ্ছে গ্যাংটক থেকে রংপো হয়ে শিলিগুড়ির দিকে, আর ব্রিজ পেরিয়ে অন্যদিকের রাস্তা নিলে সেটা যাচ্ছে তরাই পেরিয়ে ডুয়ার্সের দিকে।

DSC_0279.jpgDSC_0280.jpg

ব্রিজ পেরোতেই তরাই নতুন ভাবে নিজেকে মেলে ধরল আমার সামনে, আর আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম।

DSC_0283.jpg

বহু বহুকাল আগে কয়েকবার এ রাস্তায় এসেছিলাম, কলেজ থেকে এমনিই, কখনও পিকনিকে, কখনও কারুর সাথে ঘুরতে, সরু রাস্তা ছিল, ভাঙাচোরা গুমটি দোকানঘর ছিল, সন্ধ্যের পর সেখানে কুপি লম্ফ জ্বলত, আটটার পরে মানুষজন দেখা যেত না, এখন দেখছি রানওয়ের মত চওড়া রাস্তা দিগন্তকে ছুঁয়ে ফেলেছে দূরে গিয়ে, দুধারে যতদূর চোখ যায়, কিছুকিঞ্চিত মিলিটারি এসটাবলিশমেন্ট, তা বাদ দিয়ে চা বাগান, চা বাগান, অনন্ত চা বাগান। উজ্জ্বল সবুজ রঙের চা বাগান সোজা গিয়ে মিশেছে নীলচে পাহাড়ের কোলে, সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য, আগে কখনও এভাবে অনুভব করি নি। উত্তরবঙ্গ পুরো ভোল পালটে ফেলেছে, জায়গায় জায়গায় সেই কুড়ি বছর আগে দেখা ছোট ছোট টাউনেরা আসছে, মংপু, কালীঝোরা, ওদলাবাড়ি, ডামডিম, মালবাজার। মালবাজারে এসে তো আমি চমকে গেছি, এ একেবারে ছোটখাটো একটা শহর! বড় বড় বাড়িঘর শপিং প্লাজা, কয়েক হাত অন্তর অন্তর পেট্রল পাম্প, অনবরত যাতায়াত করছে মিলিটারির গাড়ি, রুটের বাস আর ভুটানের গাড়িরা। মসৃণ চওড়া রাস্তা। মালবাজার আসতে আসতে চারপাশের পাহাড়েরা হাওয়া, আর তাদের দেখা যাচ্ছে না, যদিও চা বাগানেরা রয়েছে সবসময়েই, এ সব এলাকার টি গার্ডেন তো নামকরা, ওদলাবাড়ি টিএস্টেট, বিন্দু, চালসা – এক সময়ে এই রাস্তা ধরেই এসেছিলাম তিস্তা নদীর চরে পিকনিক করতে, চালসা টি গার্ডেনের পাশ দিয়ে, মনে আছে সেদিন ছিল পূর্ণিমা, বিকেলের পরে তিস্তার জল থেকে উঠে এসেছিল ইয়াব্বড়ো একটা থালার মত চাঁদ, একজন গিটার নিয়ে গেছিল, তিস্তার ওপর একটা বোল্ডারে বসে আমাদের সমবেত হুল্লোড়ে গাওয়া পাপা কহতে হ্যায় … অন্য জন্ম মনে হয়, পূর্বজন্ম মনে হয়। এখন আর কিছুই চিনতে পারি না। সব শহর হয়ে গেছে, সেই সব ছোট ছোট গঞ্জেরা আর নেই, আর সর্বত্র, সর্বত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, কাটআউট, ব্যানার, পোস্টার।

DSC_0281.jpg

মালবাজারে মোটরসাইকেলে তেল ভরে শৌভিককে একটা ফোন করে নিলাম। ও মাদারিহাটের মোড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। মাদারিহাটের মোড় কত বড়, সেখানে শৌভিককে স্পট করব কী করে – তা তো জানি না। তবে দেখা যাক।

মালবাজার ছাড়াতেই আশপাশের দু চারটে ট্র্যাফিক ব্যারিকেড দেখে বুঝলাম, আমি এইবারে আলিপুর দুয়ার জেলায় ঢুকে পড়েছি। আলিপুর দুয়ার ছিল জলপাইগুড়ির একটা মহকুমা, জলপাইগুড়ি জেলার একমাত্র পাহাড়ী অঞ্চল – ডুয়ার্স। আমার জন্মস্থান। আমার এক বছর বয়েসে বাবা সেখান থেকে বদলি হয়ে চলে আসে বর্ধমানের গুশকরা গ্রামে, ফলে আলিপুর দুয়ারের কোনও স্মৃতি আমার নেই, শুধু মায়ের কাছে গল্প শুনেছি সেখানে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাঠের ঘরে আমরা ভাড়া থাকতাম, সেখানে নেপালি আয়া মা-কে কমলালেবু ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাওয়াত। আশেপাশে নানা রকমের জায়গা, পিকনিক স্পট, রাজাভাতখাওয়া, ফাঁসিদেওয়া – সেইখানে একবার পিকনিক করতে গিয়ে বাবা মা বুনো হাতির মুখে পড়েছিল, সে গল্প অন্যত্র লিখেছি।

জেলা হয়ে আলিপুর দুয়ার এখন আকারে বহরে বেড়েছে। শুধু পাহাড় নয়, সমতলের কিছু এলাকাও এখন আলিপুর দুয়ার জেলায় চলে এসেছে – চালসা, কুর্তি, চ্যাংমারি, দেবপাড়া, বানারহাট, বিনাগুড়ি, গয়েরকাটা, বীরপাড়া, মাদারিহাট, হাসিমারা (সমেত জলদাপাড়া অভয়ারণ্য) এবং জয়গাঁও। সমস্ত এখন নতুন জেলা, এবং আমার কুড়ি বছর আগে দেখে আসা স্মৃতির সঙ্গে আজকের সেই সব জায়গার কোনও মিল নেই।

মাদারিহাট – হায়, সেখানে একটা ঝুপসে জীবনের প্রথম শুওরের মাংস, ঝাল ঝাল আর রুটি খেয়ে এক রাত টুরিস্ট লজে কাটিয়েছিলাম, তখন জেনারেটরে করে টুরিস্ট লজে লাইট জ্বলত, বাকি কোথাও ইলেকট্রিসিটির কানেকশনই ছিল না, মূলত মদেশিয়া রাজবংশী ইত্যাদি আদিবাসীদের বসতি – সেই মাদারিহাট আজ ঝলমল করছে সারিসারি দোকানপাট শোরুমে। এটিএম, পেট্রল পাম্প, জুয়েলারির দোকান, রেস্টুরেন্ট – কী নেই? এমনকি ট্রাফিক সিগন্যাল এবং ট্রাফিক কন্ট্রোল করা পুলিশও রয়েছে মোড়ের মাথায়, শেষ যখন দেখেছি – তখন ট্র্যাফিকই ছিল না এ রাস্তায়, রাস্তাটাই কত সরু ছিল! সারাদিনে দুচারটে বাস যেত, বাকি শুধু সাইকেল।

মাদারিহাটের মোড়টা খুব বড়সড় কিছু না, শুধু সেখান থেকে রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে গেছে। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে তো শৌভিককে দেখতে পেলাম না, কিন্তু মোড় থেকে বাঁকতেই দেখি রাস্তার ধারে একটা বুলেট দাঁড়িয়ে আছে, আর বুলেটে বসে আছে যে লোকটি – বাইশ বছর বাদে দেখলেও সে লোকের মুখ খুব একটা বদলায় নি। আমার তুলনায় শৌভিকের গোঁফ উঠেছিল একটু তাড়াতাড়িই, সেই গোঁফ এখন পুরুষ্টু, বয়সোচিত একটু ওজন লেগেছে শরীরে, কিন্তু মুখ আর চশমার ফ্রেমটা সেই একই রকমের আছে।

শৌভিক বলল, চল, আগে জয়গাঁও পৌঁছই, ওখানে পৌঁছে গল্প হবে। বেশ, তাই চলা যাক।

খুব বেশি রাস্তা আর বাকি ছিল না, বেলা দুটো নাগাদ জয়গাঁও পৌঁছে গেলাম। যথারীতি – জয়গাঁওও আর আগের মত নেই। প্রথমত জয়গাঁও ঢোকার মুখে বেশ খানিকটা রাস্তা ভাঙাচোরা, জয়গাঁও টাউনে ঢুকলাম রাস্তার দুপাশে উপচে পড়া নোংরা নিয়ে, বর্ডারের এক কিলোমিটার আগে থেকে রাস্তার মাঝে শুরু হয়েছে ডিভাইডার, আর দুপাশে রাশিরাশি দোকান, শোরুম, প্লাজা, এটিএম, ব্যাঙ্ক, মন্দির, গুরুদোয়ারা, মসজিদও। এবং মন্দির। এরা কি আগে ছিল?

DSC_0284.jpg

জয়গাঁও পুলিশ স্টেশনটি একদম রাস্তার ওপরেই। সেখানে মোটরসাইকেল রেখে ভেতরে ঢুকলাম, স্বরাজের নাম করতেই সবাই চিনল, কিন্তু ‘স্যার তো এখন নেই, ডিউটিতে গেছেন বিকেলে আসবেন’। তা হলে উপায়? স্বরাজকে ফোন করলাম, ফোনে স্বরাজ বলল, এক কাজ কর – থানার বাইরেই দেখবি কালীমন্দির, ওর পাশে মুখার্জি প্লাজা। প্লাজার দোতলায় একটা হোটেল আছে কস্তুরী বলে। আমি বলে রেখেছি, ওখানে গিয়ে আমার নাম করলেই পাঁচ নম্বর রুম খুলে দেবে। তুই যা, ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে, আমি বিকেলে এসে তোকে ডেকে নিচ্ছি।

কস্তুরীতে গিয়ে বলতেই খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, স্যার বলে গেছেন, আসুন স্যার, আসুন – বলে সত্যিই পাঁচ নম্বর রুম খুলে দিল। আমি আর শৌভিক ঢুকে ঘরের দখল নিলাম। … তবে বিশ্রাম নেবার সময় এখনও নেই, পাশে থানার পার্কিংএ মোটরসাইকেলে সমস্ত লাগেজ বাঁধা রয়েছে, সেগুলোকে তুলে আনতে হবে। আমরা দুজনে মিলে ধরাধরি করে একবারেই তুলে আনলাম সমস্ত লাগেজ, এইবারে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসা গেল। আঃ, কী আরাম। ঝট করে চানটাও সেরে নিলাম।

অনেক অনেক গল্প হল – যেমন হয় আর কি, পুরনো দিনের গল্প, মোটরসাইকেলের নেশা চড়ার গল্প, আরও এদিক সেদিক। তিনটে নাগাদ বোঝা গেল, খুব খিদে পেয়েছে। এই দোতলাতেই ওদের বিশাল বড় খাবার জায়গা, সেইখানে গিয়ে খাবার অর্ডার দেওয়া, খাওয়া, এবং তার পরে আবার খানিক আড্ডা।

পাঁচটা নাগাদ শৌভিককে বিদায় নিতে হল, ও মাদারিহাট ফেরত যাবে, ওর কাছাকাছিই ওর শ্বশুরবাড়ি, সেইখানে ফিরতে হবে। কয়েকটা ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল বুঝে ওঠার আগেই আমরা নিচে নেমে এলাম, শৌভিক ওর বুলেটে স্টার্ট দিয়ে মিলিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে।

ঠিক পৌনে ছটা নাগাদ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল আমার মোবাইলে – জিনু, ফ্রেশ হয়েছিস? আমি স্বরাজ বলছি, অফিসে এসে গেছি। চলে আয়।

ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে সকলেরই একটা নিকনেম তৈরি হয়। আমার নাম ছিল জিনু। কারণ কিছুই না, র‍্যাগিং পিরিয়ডে আমাকে লাগাতার গান গাইতে হয়েছিল, আর আমি তখন সুমনের প্রথম চার পাঁচটা ক্যাসেটের সমস্ত গান হুবহু গেয়ে দিতে পারতাম। এদিকে জলপাইগুড়ির ক্যাম্পাসে সুমন তখনও সেইভাবে এন্ট্রি পান নি, ফলে ক্যাম্পাসে সুমনের গান গেয়ে আমার নাম হয়ে গেছিল ‘জীবনমুখী’। সেইটারই শর্ট ফর্ম, জিনু।

স্বরাজ তার ঘরে বসে ছিল অফিস আলো করে। শেষ তাকে দেখেছিলাম রোগা লিকলিকে চেহারা, আর এখন দেখছি আমজাদ খানের মত মোটা একজনকে। আঠেরো বছর বাদে দেখা। গল্প হল আবারও, অনেক। কীভাবে কীভাবে এদিক সেদিক চাকরি করতে করতে কাগজে সাব ইন্সপেক্টর পদে ভর্তির বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করা, আর সেই থেকেই পুলিশে চাকরি করা, জয়গাঁওতে আসা, বর্ডার টাউন হিসেবে কত রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া – সে সব লিখতে গেলে হয় তো আলাদা বই হয়ে যাবে, মোদ্দা কথা এটাই বোঝা গেল, জরাসন্ধের যুগ পেরিয়ে এলেও পুলিশের চাকরিতে বৈচিত্র্য খুব একটা কমে না।

কথায় কথায় ভুটানের পারমিটের কথা উঠল। স্বরাজও আমাকে একজন এজেন্টের নাম ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আমার যেহেতু উগিয়েনের মাধ্যমে একেবারে ই-ভিসাই হয়ে গেছে, ফলে আর সেই এজেন্টের দরকার পড়ে নি। সেটাই জানিয়ে দিলাম। এক ফাঁকে স্বরাজ বলে দিল, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছিস তো? রাতে আমরা খেতে বেরোব তোকে নিয়ে।

বাঃ, বেশ কথা। খাবার ব্যাপারে আমি কখনওই অরাজি হই না।

এ কথা, সে কথার পর এইবারে প্রসঙ্গ উঠল আমার বাইক নিয়ে এই ঘোরাঘুরির প্রসঙ্গ। ‘জিনু, তোকে তো যখন চিনতাম তখন এ সব শখ টখ হতে দেখি নি, কবে থেকে এ সব করছিস?’ … বললাম ছোট করে আমার গল্প। শুনে খুব খুশি হয়ে স্বরাজ বলল, ‘কলেজের সকলের সঙ্গে তো তুই বোধ হয় আর যোগাযোগ রাখিস না, তাই না?’

না। আমাদের সেই দোতলা ব্যাকের ছেলেপুলেরা একবার একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে সেখানে আমাকে অ্যাড করেছিল। বাপ রে, সপ্তাহখানেক থেকে বুঝতে পেরেছিলাম আমি ওখানে ভয়ঙ্কর রকমের মিসফিট। মাঝখানের এতগুলো বছরে আমার মানসিকতাই হয় তো পালটে গেছে, কিংবা তাদের – কে জানে, আমি দেখলাম, কিছু ছেলে সর্বদাই ইংরেজিতে লিখছে, অথচ গ্রুপের সবাই বাঙালি, কিছু পাবলিক সর্বদাই এদিক সেদিক থেকে বস্তাপচা হাসি-পায়-না-এমন লো উইটের জোক শেয়ার করছে, বাকিরা তাই পড়ে ইমোটিকনের বন্যা বওয়াচ্ছে, আর কয়েকজন জাস্ট কিছু কিছু পোস্টের পর আগের পোস্টদাতার পিঠ চুলকে দিচ্ছে ভার্চুয়ালি – বাঃ, নাইস ওয়ান, ওয়াও, কী দারুণ লিখলি রে … ইত্যাদি। – মানে, হয় তো পুরনো কলেজদিনের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমার পোষায় না, আমি গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছিলাম এক সপ্তাহ বাদে।

সেই গল্পই করছিলাম স্বরাজের সাথে, এমন সময়ে স্বরাজ বলল, সুকান্তদাকে মনে আছে?

সুকান্তদা? সে কে?

স্বরাজ বলল, আমাদের এক বছরের সিনিয়র, সুকান্ত দাস। মনে নেই?

অনেক কষ্টেও মনে করতে পারলাম না, তবে সেটা বুঝতে না দিয়ে মুখে কৃত্রিম উৎসাহ ফুটিয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, সুকান্তদা তো? কী খবর তার?

স্বরাজ একগাল হেসে বলল, সে-ও তোর মতই পাগল। তবে ও সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দাঁড়া তোর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিই। – বলে ফোনে নম্বর হাতড়াতে লাগল।

আমি প্রমাদ গণলাম। সত্যিই মনে পড়ছে না। কী কথা বলব? স্বরাজ ততক্ষণে ফোনে ধরে ফেলেছে সুকান্তদাকে – আরে সুকান্তদা, স্বরাজ বলছিলাম, কেমন আছো? … হ্যাঁ, লখনউতে? আচ্ছা, তোমার জিনুকে মনে আছে? আমাদের ব্যাচের – গান টান করত, … হ্যাঁ, সেই জিনু এখন আমার সামনে বসে আছে, কী কীর্তি করেছে, দিল্লি থেকে সোজা মোটরসাইকেল চালিয়ে আমার এখানে এসে উঠেছে – হে হে, … হ্যাঁ, এই নাও, কথা বলো।

ফোনটা নিলাম। স্বরাজের অফিসঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা লম্বা কাঠের বোর্ড, তাতে পর পর লেখা আছে, এই চেয়ারে এর আগে কে কে কবে থেকে কবে পর্যন্ত বসে গেছেন, সাদা রঙের সরকারি অক্ষরদের আমি দেখছি, শেষ নামটা স্বরাজের, To তারিখের জায়গাটা খালি, ঠিক সেই সময়েই ফোনের মধ্যে থেকে একটা গলা, যেন কতদিনের পরিচিত, ভেসে এল – ‘কী রে জিনু? আরে, তোর আসল নামটা কী যেন ছিল? আমি তোকে ঠিক প্লেস করতে পারছি না।’

চিনতাম না তো কী হয়েছে? চিনে ফেলতে লাগল ঠিক কয়েক সেকেন্ড, লখনউতে থাকে, ওখানেই চাকরিবাকরি, সাইকেলে করে ঘোরার প্রসঙ্গ উঠতেই খুব লজ্জা পেয়ে বলল, আরে না না, সে রকম কিছু না, ঐ একবারই সাইকেল চালিয়ে একটা লম্বা ট্রিপ করেছিলাম – লখনউ থেকে ব্যাঙ্গালোর।

আমাকে নড়েচড়ে বসতেই হল। লখনউ থেকে ব্যাঙ্গালোর – মানে, কিছু না হোক, দু হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব এই আপাত-অচেনা লোকটি সাইকেলে করে পেরিয়েছে? বলে কী?

মুখে বেশি কিছু বললাম না, কিন্তু মনের খাতায় নোট করে নিলাম, আমাকে এর সাথে দেখা করতেই হবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুকান্তদা, তুমি থাকো কোথায়?’

‘লখনউ।’

আরিব্বাস! আমি তো এসেছি লখনউয়ের ওপর দিয়েই, আগে জানলে দেখা করে আসা যেত। ফেরার পথে কি সম্ভব হবে? ফেরা তো আমার হুগলি থেকে, বেনারস হয়ে সোজা রাস্তাটা এলাহাবাদ কানপুর হয়ে, কিন্তু চাইলে তো ওটাকে লখনউ হয়ে ফেরার রাস্তা করে নেওয়াই যায়। লখনউ থেকে সোজা এক্সপ্রেসওয়ে একদম আগ্রা হয়ে আমার বাড়ির সামনে পর্যন্ত, নন-স্টপ। জানি না, সম্ভব হবে কিনা।

মুখে বললাম, সুকান্তদা, আমি চেষ্টা করব, ফেরার পথে তোমার সাথে দেখা করবার। আমার ফেরার দিন সোমবার পড়বে, হয় তো তোমার অফিস থাকবে, তবে বোলো, সে রকম হলে আমি তোমার অফিসের গেটে গিয়েও দেখা করে আসব।

ফোনটা রেখে স্বরাজকে ধন্যবাদ দিতেই হল এমন একটা কনট্যাক্ট জোগাড় করে দেবার জন্য। সুকান্তদার নম্বরটা নোট করে নিলাম আমার মোবাইলে। এবার পরের কাজ। কাল ভুটান ঢুকব। প্রথমদিনের গন্তব্য পারো। তো, সবার আগে ভুটানের একটা সিমকার্ড জোগাড় করতে হবে। স্বরাজকে বলামাত্র, ডেস্ক থেকে একটা মোবাইল বের করে তার সিমকার্ডটা খুলে বের করে আমাকে দিয়ে বলল, এই নে, ফেরার সময়ে ফেরত দিয়ে যাস মনে করে।

সাড়ে সাতটা নাগাদ স্বরাজ উঠল চেয়ার থেকে। ততক্ষণে দারুণ দারুণ সব গল্পের স্টক জমে গেছে আমার ঝুলিতে ওর কল্যাণে। কীভাবে আধার কার্ড আর পাসপোর্টের জালিয়াতি হয় এই অঞ্চলে, ভুটান পাহাড়ে বন্যা হলে ভুটানিজদের জিনিসপত্র কীভাবে নদীতে ভেসে নেমে আসে ভারতে, পরে সেগুলো কিছু উদ্ধার হয়, কিছু হয় না, কিছু স্থানীয় লোকেরা আত্মসাৎ করে নেয়, পুলিশ কীভাবে সেইসব ক্লেম হ্যান্ডল করে – সে এক বিস্তারিত ব্যাপারস্যাপার। … যাই হোক, সাড়ে সাতটার সময় উঠে স্বরাজ বলল, জিনু, তুই তা হলে আরেকটু রেস্ট করে নে, আমরা নটা নাগাদ খেতে বেরোব, তুই এখানে চলে আসিস আবার নটার সময়ে।

হোটেলে ফিরলাম আবার। চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকতেই, মাথাটা কেমন যেন একটু টলে গেল। শরীরটা, ঠিক যেন ভালো ঠেকছে না। পেটের কাছে সামান্য একটু টান, তার পরেই আর কিছু নেই। … বিছানায় এসে বসলাম। একটানা চলছি, কদিন নাওয়াখাওয়ার ঠিক নেই, সমস্যা হতেই পারে। একঘণ্টা আছে এখনও বেরোতে, না করে দেব? নাকি বেরোই – বেশি কিছু খাবো না?

খানিক বাদে উঠে চোখেমুখেঘাড়ে জল দিলাম, মনে হল এখন ঠিক আছে। পেটে হালকা একটা অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু সেটা হজম সংক্রান্ত কিছু না, কী রকম যেন কিছু একটা টেনে ধরছে ভেতর থেকে, আবার ততটাও কিছু মারাত্মক নয়। ইগনোর করে নেওয়াই ভালো। ফিরে এসে ঘুমিয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

নটার সময়ে আবার যখন নিচে নেমে থানার দিকে এগোলাম, তখন আমি একদম ঠিকঠাক। কোনও অস্বস্তি নেই কোথাও। স্বরাজ থানার গেটেই দাঁড়িয়ে ছিল, একটা গাড়ি এসেছে, স্বরাজের সঙ্গে আরও দু তিনজন লোক, তারা পুলিশ না স্থানীয় বাসিন্দা নাকি স্বরাজের বন্ধু, জানি না – আলাপ হল এক এক করে।

গাড়িতে চেপে বসলাম, গাড়ি থানার গেট পেরিয়ে যখন রাস্তায় নামল, তখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে।


2 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১১

  1. চালসা, কুর্তি, চ্যাংমারি, দেবপাড়া, বানারহাট, বিনাগুড়ি, গয়েরকাটা, এগুলো জলপাইগুড়ি। ফাঁসীদেওয়া দার্জিলিং।

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.