দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৯

অষ্টম পর্বের পরে

সাতাশে অক্টোবর, অষ্টম দিন

ধড়মড় করে উঠে বসলাম যখন ঘুম ভেঙে, দেখলাম কাল রাতে ঘরের লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। ল্যাপটপ বন্ধ করেই কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। কী সব উদ্ভুট্টে স্বপ্ন টপ্ন দেখছিলাম কে জানে – এক ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলের সুইচ টিপে দেখি পৌনে সাতটা বাজে। সোনমের মেসেজ এসেছে, আমি গ্যংটক ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা, জানতে চেয়ে। ওকে ঝটপট রিপ্লাই করে দিলাম – কত সহজে এখানকার লোকজন, কত অল্প আলাপেই এ রকম আপন হয়ে যায়।

আজ আবার সেইখানে যেতে হবে – পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিসে, এইবারে ইস্ট সিকিমের জন্য পারমিট স্লিপ কাটতে যেতে হবে। তার ওপর মোটরসাইকেলের কেরিয়ারের দু দুখানা রড খুলে গেছে, ডানদিকের ফ্রেমের অন্তত দু জায়গায় স্ক্রু আলগা হয়ে সমানে ঘটঘট আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে, সামনে এখনও বেশ কয়েক দিনের জার্নি। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক শেপে না আনলে পরে মুশকিলে পড়তে হবে। গ্যাংটক শহরে এই সব সারানোর প্রচুর জায়গা আছে – দেখে এসেছি, যত সময়ই লাগুক, সমস্ত ঠিক করে নিয়েই বেরোতে হবে।

সকালের ব্রেকফাস্টের জন্য অর্ডার করেছিলাম পুরি-ভাজি, সেটা আর কিছুই না, বাঙালি লুচি আর আলুর ঝোল। পেটপুরে খেলাম। ফ্রেশ টেশ হয়ে একদম পৌনে আটটায় বেরোলাম। পারমিট স্লিপ আনতে।

আগের দিনের পুলিশটিই ছিলেন। আবার সেই চিঠি দেখানো হল – উনি জিজ্ঞেস করলেন, এবারেও কি ইস্ট সিকিম করে আবার গ্যাংটকে ফেরত আসবে?

না, আমার আর ফেরার নেই, ওখান থেকে সোজা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে যাব। সে কথা জানাতেই ঘসঘস করে পারমিট লিখে দিয়ে আমার হাতে তুলে দিলেন। পুরো প্রসেসটায় সময় লাগে তিন মিনিট ম্যাক্সিমাম। আবার ফিরে যাওয়া সেই জেরক্সের দোকানে, দশ কপি করিয়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। হোটেলে ফেরার পথেই পেট্রল পাম্প পড়ে, তার পাশেই গাড়ি আর বাইকের সার্ভিস স্টেশন – দেখে এসেছি। আগে পেট্রল ভরে নিই।

কিন্তু না, গ্যাংটক শহরের একদম মাঝামাঝি অবস্থিত এই পাম্পে পেট্রল নেই। তা হলে উপায়? পাম্পের লোকটিই বললেন – এই রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে যান (যেটা আসলে আমার হোটেলে যাবারই রাস্তা), পাঁচ কিলোমিটার গেলে পেট্রল পাম্প পাবেন, ওতে তেল থাকবে। সবাই ওখানেই যাচ্ছে। অগত্যা, মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম সার্ভিস স্টেশনে। ছেলেটাকে রড আর ক্যারিয়ারের ফ্রেম দেখানো মাত্র, সে চটপট তার টুলবক্স থেকে কয়েকটা নাটবল্টু বের করে ঠিক কুড়ি মিনিটের মধ্যে জিনিসটাকে আবার শক্তপোক্তভাবে সেট করে দিল আমার মোটরসাইকেলের সঙ্গে। এক্কেবারে প্রথম দিনের মত। ভয়ে ভয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, নাথুলার দিকে রাস্তা কেমন? ছেলেটা খুব কনফিডেন্সের সাথে বলল, এদিকের রাস্তা একদম ঠিকঠাক, মাঝে সামান্য খারাপ আছে।

হোটেলে ফিরে এলাম। লাগেজ সমস্ত বেঁধেছেঁদে একবারে বেরোলাম। পেট্রল ভরে বেরোব।

দ্বিতীয় পেট্রল পাম্পটা খুব সহজেই পেয়ে গেলাম খানিক এগোতেই। ভালো করে পেট্রল ভরে, দুটো জেরিক্যান ফুল করে, আবার ফিরে আসা হোটেলের রাস্তায়, এবং এখান থেকেই এবার সোজা ছাঙ্গুর রাস্তায়।

সাড়ে নটা বাজে। খুব দেরি কিছু হয় নি, কারণ আজ আমার গন্তব্য মাত্রই পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে। নাথাং ভ্যালিতে, নাথাং রেসিডেন্সি। আরামসে পৌঁছে যাবো। দেখার জিনিস তো মাত্র দুটো – ছাঙ্গু লেক আর নাথুলা পাস। সিকিমের পূর্ব অংশের এই রাস্তা অতি প্রাচীন সিল্ক রুটের অংশ। অতি প্রাচীন এই রাস্তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হত ভারতের সাথে চীনের ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য, এবং এই রাস্তাটিই বিভিন্ন সিল্ক রুটের মধ্যে একমাত্র পথ, যা আজও ভারত আর চীনের মধ্যে স্থলপথের বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়।

গ্যাংটক শহর থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই বোর্ডে বড় বড় করে সো-ঙ্গো (Tsomgo) লেখা বোর্ড পেরিয়ে ছাঙ্গুর রাস্তা ধরলাম। একটু এগোতেই আর্মির ব্যারিকেড, সেখানে একটা চিঠির কপি জমা দিয়ে এগোনো, এবং আরও একটু এগোতেই মোবাইল থেকে নেটওয়ার্ক চলে গেল।

খানিক ওঠার পরে মেঘেরা দল বেঁধে সঙ্গ নিল, কখনও মেঘের মধ্যে দিয়ে, কখনও দূর থেকে তাদের পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা উঠতে লাগল। … অনেক, অনেক বছর আগে আমি এই রাস্তায় এসেছিলাম, এখন আর কিছুই চিনতে পারছি না অবশ্য।

উনিশশো সাতানব্বই বোধ হয়, নাকি ছিয়ানব্বই? নীলাদ্রিদার সঙ্গেই এসেছিলাম গ্যাংটক। ফেব্রুয়ারি মাসে, চূড়ান্ত ঠাণ্ডায়, সিকিম বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা বাঙালি হোটেল ছিল, হোটেল শান্তিনিকেতন। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীরারিং কলেজের ছাত্রদের অন্য একশো টাকায় রুম ভাড়া পাওয়া যেত। জাস্ট টুকরোটাকরা দু তিনটে স্মৃতিই মনে আছে, সেই আমার প্রথম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রার অনুভূতি পাওয়া – রাতে খেয়ে উঠে হাত ধুতে গিয়ে মনে হয়েছিল হাতটা আর নেই, এত অসাড় হয়ে গেছিল, ছাঙ্গু যাচ্ছিলাম আমরা একটা কম্যান্ডার জীপে, আরও কিছু টুরিস্টদের সঙ্গে, রাস্তা বেশ ভাঙাচোরা ছিল, খানিক ওপরে উঠে দেখেছিলাম আমরা ওপরে – পাশে পাহাড়ের খাদে আমাদের থেকে নিচের দিকে মেঘ ভাসছে, মানে আমরা তখন মেঘের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাশ দিয়ে মিলিটারির ট্রাক যাচ্ছিল, সেই প্রথম ট্রাকের চাকায় চেন বাঁধা অবস্থায় চলতে দেখা, আর ছাঙ্গুর আশপাশ বরফে ঢাকা ছিল, একটু দৌড়তে যেতেই দম ফুরিয়ে আসছিল।

কুড়ি বছর পর আজ আমি আবার সেই রাস্তায়। এটা অবশ্য ফেব্রুয়ারি নয়, অক্টোবর, ঠাণ্ডা এখনও সেভাবে পড়ে নি। আর আজকের যাত্রায়, আমি একা। রাস্তা একদম ঝাঁ চকচকে। মাঝে অবশ্য একটুখানি ভাঙা কাদাপাথরভরা এলাকা পেরোতে হল, তবে সেটা দেখে মনে হল, সম্প্রতি ওখানে ছোট করে ধস নেমে রাস্তা নষ্ট হয়েছে। সারাইয়ের কাজ চলছে। এর বাইরে রাস্তা একদম পরিষ্কার।

আরেকটু ওপরে উঠতেই, দূর থেকে চোখে পড়ল সামনে লম্বা গাড়ির লাইন, সারি সারি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার?

কাছে যেতে পরিস্থিতি বোঝা গেল। কিছুই না, ওপর থেকে মিলিটারির ট্রাকের দল নামছে গ্যাংটকের দিকে। সরু রাস্তা, তাই ধীরে ধীরে নামতে হচ্ছে, একদিকে ওপরের দিকে যাবার গাড়ির লাইন, লাইনের বাইরে ট্রাক যাবার মত যথেষ্ট রাস্তা বেঁচে নেই, অন্যদিকে খাদ, তাই কখনও একটা করে গাড়ি এগিয়ে, কখনও একটা করে মিলিটারি ট্রাক এগিয়ে – একটু একটু করে ট্রাকগুলোকে পাস করানো হচ্ছে।

আজ এ রাস্তায় আর একটিও বাইকার দেখতে পাচ্ছি না। আমি একমাত্র। প্রায় চল্লিশ মিনিট আটকে থাকার পর দেখা গেল, আমি এমন একটা পজিশনে আটকে আছি, আমার সামনে ছটা গাড়ি, এগনোর জায়গা নেই, পিছোনোরও জায়গা নেই, ওদিকে ছ নম্বর গাড়ির সামনে একটা বাঁক, সেখান দিয়ে একটা মিলিটারি ট্রাক নামার জায়গা পাচ্ছে না। বহু কসরত করেও নামতে পারছে না, সাফিশিয়েন্ট জায়গা নেই।

সবাই এদিক ওদিক সেদিক জরিপ করে দেখে আমাকেই ধরল এসে। এমনিতে এই সব ক্ষেত্রে পাহাড়ে ওভারটেকিং স্ট্রিক্টলি নো-নো। একজন ওভারটেক করতে গেলেই পুউরো কেস একদম সেই খাইবার পাস হয়ে যাবে, ক-রে কমললোচন শ্রীহরি, খ-রে খগ আসনে মুরারি। কিন্তু আমি মোটরসাইকেলে আছি। আমি গাড়িদের থেকে কম প্রস্থ নিচ্ছি, অতএব, সামনের ছ নম্বর গাড়ি আর উল্টোদিকের ট্রাকের মাঝে যেটুকু ফাঁক আছে, সেখান দিয়ে একমাত্র আমিই গলে যেতে পারব, আর আমি গলে গেলে আমার জায়গায় তৈরি হওয়া ফাঁকটাতে একটা একটা করে ছটা গাড়ি পিছিয়ে এলে ট্রাকটা এগোবার জায়গা পেয়ে যাবে।

উত্তম প্রস্তাব। টুক করে এগিয়ে গিয়ে গলে গেলাম ফাঁক দিয়ে – পেছনে আরও চারটে ট্রাক ছিল, কিন্তু আমার যাবার রাস্তা ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে। বাকি জ্যামও খানিক পরেই খুলে যাবে, জায়গা হয়ে গেছে আগুপিছু করবার।

আকাশে আর আমার চারপাশে মেঘরোদ্দুরের খেলা দেখতে দেখতে একটু পরেই ছাঙ্গু লেকে এসে পৌঁছলাম – কিন্তু এ কী? কুড়ি বছর আগে যে অযত্নের সৌন্দর্য দেখেছিলাম ছাঙ্গুতে, সে সৌন্দর্য তো আর নেই! দীর্ঘ লেকের পাশ দিয়ে রানওয়ের মত রাস্তা চলে গেছে, আর লেকের চারপাশ শক্তপোক্ত রেলিং দিয়ে ঘেরা। ছাঙ্গু লেকে এলাম, না কলেজ স্কোয়্যারের পুকুরের সামনে, বোঝাই মুশকিল।

DSC_0232.jpgDSC_0243.jpg

খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম। দু একটা ছবি নিলাম। কিন্তু কুড়ি বছর আগের সেই মুগ্ধতা আর ফিরে এল না। এখানেই কাছাকাছি কোথাও বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির ছিল, ইন্ডিয়ান আর্মির কুসংস্কারের ফসল – আর্মির মধ্যে বিশ্বাস, তিনি এখনও চীন সিকিম সীমান্ত পাহারা দেন, রক্ষা করেন, আর্মি থেকে এখনও বাবা হরভজন সিংয়ের নামে স্যালারি জেনারেট করা হয়, প্রতি বছর নতুন উর্দি দেওয়া হয় মন্দিরে। মন্দিরটা এখন আরেকটু দূরে কোথাও একটা শিফট করে গেছে – আমার দেখার লিস্টিতে সেটা নেই। বাবার ভূতকে একটু কষ্ট করে ডোকলামে নিয়ে গেলেই আর্মিকে এত নাকানিচোবানি খেতে হত না। যাই হোক, মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে আবার এগোলাম। একটু পরেই নাথু লা আসবে।

একটু এগোতেই ছাঙ্গুর থেকেও ওপরে চলে গেলাম, আর ওপর থেকে দুচোখ ভরে দেখলাম ছাঙ্গুকে। সামনে দাঁড়িয়ে যে সৌন্দর্য দেখে উঠতে পারি নি, শেষ বাঁকে হারিয়ে যাবার আগে সেই সৌন্দর্য দেখিয়ে দিল ছাঙ্গু। চারদিকে খাড়াই পাহাড় আর আঁকাবাঁকা রাস্তাকে কোলে নিয়ে, আধা মেঘলা আধা নীলচে আকাশের ছবি বুকে এঁকে দাঁড়িয়ে আছে ছাঙ্গু লেক। দাঁড়াতেই হল, ছবি নেবার জন্য।

DSC_0244.jpg

খানিক এগোতেই পড়ল আরেক চেকপোস্ট। আর্মির। মোটরসাইকেল সাইডে রেখে ভেতরে গিয়ে চিঠির কপি জমা দিতে হল, মোটরসাইকেলের নম্বর পড়ে আর্মি অফিসারের কৌতূহলী প্রশ্ন, দিল্লি সে আয়ে হো? আকেলা? দিল্লি মে কাঁহা পে রহতে হো? উত্তর দিয়ে বললাম, আপ ভি দিল্লি সে? অফিসার হাসলেন, না না, আমার বাড়ি হিমাচলে, আমি দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড ছিলাম তিন বছর।

হাতে একটা হলুদ কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা সাবধানে রাখো। নাথুলায় ঢোকার মুখে আরেকট চেকপোস্ট পড়বে, ওখানে জমা দিয়ে তবে এগোতে হবে – হারিয়ে গেলে কিন্তু আর নাথু লা যেতে পারবে না।

অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। কার্ডটাকে সযত্নে জ্যাকেটের পকেটে রেখে চেন টানলাম। আরও খানিক এগোতেই আবার গাড়ির লাইন, সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে – অথচ সামনের দিকটা একেবারে ফাঁকা, সেইখানে আর্মির একটা ব্যারিকেড মত। দাঁড়িয়ে যেতে হল লাইনের শেষে। এবার কী কেস?

একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম লাইনের মুখে। সমস্তই সিকিমের ট্যাক্সি। ড্রাইভাররা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গজল্লা করছে, আমিও ঢুকে গেলাম তাদের মধ্যে। জানা গেল, আর্মির খুব হাই র‍্যাঙ্কের কোনও অফিসার এসেছেন নাথু লা পাস ভিজিটে, প্রায় ভগবানের সমতুল্য র‍্যাঙ্ক। আর্মিতে হায়ারার্কি ব্যাপারটা খুব, মানে, খুবই প্রকট, ফলে সেই হাই র‍্যাঙ্কের অফিসারের ভিজিটের জন্য আপাতত খানিকক্ষণের জন্য জেনারেল সিভিলিয়ানের অ্যাকসেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই রুটে। উনি এখনই নেমে আসবেন, নেমে এলে আবার রাস্তা খোলা হবে।

দশ মিনিট গল্পগুজব সারলাম, ইতিমধ্যে হঠাৎ লাইনের মধ্যে থেকে একটা ইনোভা বেরিয়ে এসে খানিক আগুপিছু করে উল্টোমুখে দৌড় দিল – ছাঙ্গু লেকের দিকে। সামনের গাড়ির ড্রাইভার বলল, কেয়া দিমাগ লাগায়া ভাইয়া, ওদের শিলিগুড়ি যাবার ছিল, আজ সন্ধ্যেয় এনজেপি থেকে ট্রেন, বললাম আর দশ মিনিট দাঁড়িয়ে যাও, এখনই নাকা খুলে যাবে, এখান থেকে শিলিগুড়ি কাছে পড়বে, ওদের আর তর সইল না, ওরা এখন ফিরে যাচ্ছে, গ্যাংটক হয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছবার চেষ্টা করবে, কে জানে সন্ধ্যের মধ্যে শিলিগুড়ি পৌঁছতে পারবে কিনা – এদিকের রাস্তা সহজ ছিল …

বলতে বলতেই দূর থেকে দেখা গেল ভগবান নেমে আসছেন। সত্যিই ভগবানের সমতুল্য র‍্যাঙ্কের অফিসার হবেন, আগেপিছে পাইলট কার তো বটেই, সঙ্গে একটা অ্যাম্বুলেন্সও প্যাঁপোঁ করে নেমে এল লাইন ধরে, আর ব্যারিকেড পাস করা মাত্র ব্যারিকেডের দায়িত্বে থাকা দুই সেনা জওয়ান খটাস করে তাল মিলিয়ে স্যালুট ঠুকে, আকাশবাতাস বিদীর্ণ করে ‘জয়হিন্দ সাআব’ বলে ভগবানের ক্যারাভানকে বিদায় জানাল। ব্যারিকেড খুলে গেল, আমরা নাথুলা পাসের দিকে আরও একটু এগিয়ে গেলাম।

সামনেই রাস্তাটা Y-এর মতন করে দুভাগ হয়ে গেছে। ডানদিকের রাস্তাটা নাথাং হয়ে জুলুক, পদমচেন পেরিয়ে রংপো হয়ে শিলিগুড়ির দিকে যাবার রাস্তা, বাঁদিকেরটা বেশ খাড়াইভাবে উঠে গেছে ওপরদিকে, এইটা নাথুলা পাসে পৌঁছবার রাস্তা। নাথুলা টপ এখান থেকে আর চার কিলোমিটার। এন্ট্রান্সের মুখে আর্মির বাঙ্কার এবং, আবারও ব্যারিকেড। সেই হলুদ কার্ড জমা দিতে হল এখানে, দিয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম।

শেষ বাঁকটা পেরোতেই চোখে পড়ল সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সামনে একটা বিশাল বোর্ডে লেখা নাথু লা, আর তার সামনে খানিকটা ফাঁকা রাস্তা, পালে পালে লোকজন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটু দূরে একটা উঁচু জায়গার দিকে, সেখানে লাল ঢালু ছাদওলা দু তিনটে বাড়ি মতন। সামনের দিকের বিল্ডিংগুলো ভারতের, আর পেছনের দিকের বিল্ডিংগুলো চীন।

DSC_0248.jpg

মোটরসাইকেল তো গাড়ির লাইনের পাশে পার্ক করে দিলাম, কিন্তু একটু এগিয়ে দেখলাম দুজন আর্মি জওয়ান প্রায় জনে জনে ডেকে বলে যাচ্ছেন, মোবাইল ক্যামেরা সব গাড়ি মে ছোড়কে আইয়ে, আগে অ্যালাওড নেহি হ্যায়। – এইটা আমার কাছে কেলো, কারণ মোটরসাইকেলের সমস্ত লাগেজ তো বানজি কর্ডে বাঁধা, সেইখানে পাবলিকলি সেসব দড়িদড়া খুলে তাতে ক্যামেরা আর মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে আবার বেঁধে রেখে সেটাকে আনঅ্যাটেন্ডেড অবস্থায় আবার ছেড়ে রেখে আসব, এতটা বুকের পাটা আমার অন্তত নেই। আর্মি জওয়ান সমস্ত টুরিস্টকে গাড়ি-থেকে-নামা টুরিস্ট ধরেই ট্রিট করছে, মোটরসাইকেল থেকে নেমে আসা টুরিস্টও যে থাকতে পারে, সেটা তিনি হিসেবের মধ্যে ধরেন নি। অগত্যা, গলায় ক্যামেরা নিয়ে সোজা তার কাছে গিয়েই বললাম, দাদা, মোটরসাইকেলে এসেছি। রাখার তো জায়গা নেই, তবে লাগেজের মধ্যে ব্যাটারিটা ছেড়ে এসেছি – খুলেও দেখালাম – এই দেখুন, ব্যাটারি নেই, আমি এটা নিয়ে এগোই?

কিন্তু অত সহজে রাজি হয়ে গেলে ব্যাটা আর আর্মি জওয়ান কেন হবে। তবে লোকটা ভালো, মাথা নেড়ে বললেন, না, ক্যামেরা নিয়ে তো যাওয়া যাবে না, তবে ঐ যে, ঐখানে দেখুন আরেকজন দাঁড়িয়ে আছেন আর্মি ড্রেসে, ওর কাছে জমা করে ওপরে গিয়ে দেখে আসুন, নামার সময় ওখান থেকেই নিয়ে নেবেন। আমি ওকে বলে দিচ্ছি। … বলে একটা বিশাল হাঁক ছাড়লেন – কাকা, এ কাকা।

দূর থেকে কাকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। এই জওয়ান আমাকে দেখিয়ে বললেন, ইসকা ক্যামেরা অওর ব্যাগ জমা কর লেনা। বাইক সে আয়ে হ্যায়।

আমি এগিয়ে গেলাম। লাইন ধরে দর্শনার্থীরা এগিয়ে চলেছেন। সারা ভারত থেকে আসা লোক – গুজরাতি, তামিল, ওড়িয়া, হিমাচলি, বাঙালি, কত রকমের বিস্ময়বোধক বাক্য, শব্দ। সামনেই সুভেনির শপ, তার সামনেই কাকা দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাকা লোকটি বেশ হাসিখুশি, আমার পিঠ থেকে ব্যাগ আর হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে বললেন, ইতনা ভারি ব্যাগ পিঠ মে লেকে কিঁউ ঘুমতা হ্যায়? – বলে পাশেই মেডিকেল রুমের মধ্যে ও দুটো রেখে দিয়ে বললেন, জাও, ঘুম কে আও।

উঠলাম ওপরে। গল্প শুনেছি, এইখানে নাকি হাত বাড়িয়ে চাইনিজ সোলজারদের সাথে হ্যান্ডশেকও করা যায়। যদিও ধারেকাছে চাইনিজ কোনও সোলজারকেই দেখা গেল না, অবিশ্যি দেখা হলেও হ্যান্ডশেক করার চেষ্টাও করতাম না। … একটা বড় চাতাল, সেখানে ঢাউস ঢাউস শান্ত সুবোধ সুশীল ইন্ডিয়ার ছবি লাগানো পর পর, তাজমহল, ভারতনাট্যম, রয়েল বেঙ্গল টাইগার – এই সিরিজে, মানে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার মেগা ভার্সন, সবকটাই চীনের দিকে মুখ করে। … ভো পাঠক, এই ঢাউস ঢাউস ছবিগুলোকে মনে রেখে দেবেন, ভালো করে মনে রাখবেন ভারতের এই সুবোধ সুশীল ব্যানারগুলোকে – আমরা আবার এর বিবরণ নিয়ে ফিরে আসব কয়েক পর্ব পরেই। আপাতত, সামনে একটা বিশাল পাঁচিল, চীনের পাঁচিল, না মানে সেই ঐতিহাসিক চীনের প্রাচীর নয়, এটা ভারত চীন বর্ডার, আর পাঁচিল বরাবর কাঁটাতারের ফেন্সিং লাগানো, তার বেশি কাছে যেতে দিচ্ছে না ওখানে দাঁড়ানো ইন্ডিয়ান আর্মির লোকজন, তারই মধ্যে আমি একটু এগিয়ে ঝুঁকে দেখে এলাম, চাতালের শেষ মাথায় পাঁচিলের নিচের দিকে একটা বিশালাকার রাজকীয় লোহার গেট। একজন আর্মিকে জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তা ধরেই কি মানস সরোবরের যাত্রা হয়?

উনি বললেন, হাঁ জি, ইসি রোড সে কাফিলে আগে নিকলতে হ্যায়। এহি হ্যায় সিল্ক রুট।

ফিরে এসে কাকার সাথে হ্যান্ডশেক করে ব্যাগ আর ক্যামেরা ফেরত নিলাম, আবার হেঁটে হেঁটে মোটরসাইকেলের কাছে আসার মুখে কী রকম মনে হল পকেটের মধ্যে যেন ফোনটা কেঁপে উঠল। এমনিতে ফোন নিয়ে যাওয়া মানা, তবে আমি ফোনটাকে পকেটের মধ্যেই রেখেছিলাম, সিগন্যাল তো নেই, বাজবেও না, কেউ টেরও পাবে না। – পায়ও নি।

DSC_0250.jpg

ফাঁকা জায়গা দেখে সন্তর্পণে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম, একটা এসেমেস এসেছে এইমাত্র, আর, আর, আমার ফোনে ফুল সিগন্যাল। রোমিং নিয়েছে চায়নার কোনও এক ইউনিকম নামের মোবাইল অপারেটরের সিগন্যালের। আমার মোবাইলের ঘড়িতে তখন বাজে চারটে বেজে চার মিনিট – চীনের সময়, আসলে তখন ভারতীয় সময় দুপুর একটা চৌত্রিশ।

20171029_185057

আবার নেমে এলাম সেই ওয়াই জংশনে, এইবারে নেমে নাথাং ভ্যালির পথ ধরলাম। পথের দেখার জিনিস আজকের মত এখানেই শেষ, এইবারে হোটেল খুঁজতে হবে। মোবাইলে বারও কোনও সিগন্যাল নেই, তবে আমি নাথাং রেসিডেন্সির লোকেশন অফলাইনে সেভ করে রেখেছিলাম, ফলে নেভিগেশন করতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হল না – এমনিতেও রাস্তা একটাই।

একটু এগোতেই চোখে পড়ল পাশাপাশি দুটো লেক, এমনিতে ছোট ছোট দুটো ডোবার মত দেখতে, কিন্তু পাহাড়ে এদের সৌন্দর্যই আলাদা। অ্যাজ সাচ কোনও নাম নেই এদের, নাথু লার কাছে টুইন লেক নামেই খ্যাত এরা।

DSC_0255.jpg

গ্যাংটকের মূল টুরিস্টের ঢল এই নাথু লা-তে এসেই শেষ হয়ে যায়। এর পর একেবারে ফাঁকা রাস্তা। যতদূর চোখ যায়, আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই, কোনও গাড়ি নেই। গাছপালা প্রায় কমে এসেছে, ছোট ছোট কাঁটাগাছ রাস্তার দুদিকে কী পরম সৌন্দর্যের সাথে বেড়ে উঠেছে, লাল রঙের কাঁটাঝোপ, আর মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, শুধু মনে হয় চলতেই থাকি, চলতেই থাকি … চলতেই থাকি … মাঝে মাঝে মেঘেরা আসছে, ভিজে হাওয়া আর জলকণারা চেপে বসছে হেলমেটের ভাইসরের ওপর, ভাইসর তুললে তারা বসে পড়ছে আমার চোখের পাতায়, কয়েক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না, আবার মেঘ পেরিয়ে এলেই ঝকঝকে রোদ্দুর আর ঝিকমিকে নীল আকাশ।

নাথাং এসে গেলাম একটু পরেই, রাস্তা সোজা চলে গেছে জুলুকের দিকে, জিপিএস তো তাইই বলছে, কিন্তু জিপিএস বলছে এইখানে আমাকে নিচের দিকের সরু রাস্তাটায় ডাইভার্সন নিতে হবে। এটা কাঁচা রাস্তা, এবড়োখেবরো, উঁচুনিচু, এই রাস্তায় আর তিন কিলোমিটার গেলেই নাকি নাথাং রেসিডেন্সি।

নাথাং রেসিডেন্সি। নাম শুনলেই বেশ হাইফাই হোটেল মনে হয়, কিন্তু মোবাইল সিগন্যালবিহীন এলাকায় এমন হোটেল চালায় কী করে? আর তিন কিলোমিটার দূরেই যে হোটেল – তার ত্রিসীমানায় লোকবসতি নেই কেন? যতদূর অবধি চোখ যাচ্ছে, শুধু পাহাড়, ছোট ছোট ঝোপজঙ্গল, আর মেঘ। মনুষ্যবসতির স্রেফ কোনও চিহ্নই নেই কোথাও। কিন্তু জিপিএস আমাকে দেখাচ্ছে নাথাং রেসিডেন্সির দিকে আমি ক্রমশ এগিয়ে চলছি।

এক একটা বাঁক ঘুরছি, আর ভাবছি, এই বুঝি নাথাং ভ্যালির লোকবসতি দেখতে পাবো, এই বুঝি দেখা যাবে, কিন্তু না – দূরত্ব কমতে কমতে তখন দুশো মিটার, তাতেও একটা কুঁড়েঘরও চোখে পড়ল না। তা হলে কি ভুল রাস্তায় এলাম? ফিরে যাবো আবার মেন রোডে?

ভুলটা ভাঙল আর ঠিক একশো মিটার এগোতেই। শেষমাথায় একটা বাঁক, আর সেই বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল ছোট্ট একটা গ্রাম, হ্যামলেট। সেটা এমন জায়গায় পাহাড়ের কোলে অবস্থিত, যে পেছনের রাস্তার কোনও বাঁক থেকেই তাকে দেখতে পাবার কথা নয়।

গ্রামে তো পৌঁছলাম। জিপিএসও বলছে ডানদিকেই ঘিজিমিজি অতগুলো বাড়িঘরদোরের মধ্যে কোনও একটার নামই নাথাং রেসিডেন্সি। কিন্তু কোনটা?

গ্রামের সমস্ত দোকান বন্ধ। ঘড়িতে বাজে সওয়া দুটো। একটি বুড়ো আর দুটি বাচ্চা কেবলমাত্র দৃশ্যমান। তাদের কেউ যে হিন্দি বুঝবে, আর বুঝলেও নাথাং রেসিডেন্সি খায় না মাথায় দেয় তা বুঝবে, এমন প্রত্যয় হল না। তবুও, তাদের জিজ্ঞেস করা ছাড়া তো উপায় নেই। জিজ্ঞেস করলাম। বৃদ্ধ আরেকজন কাকে ডেকে আনলেন। দুজনে মিলে খুব আলোচনা করে ঠিক করলেন সামনে যে হলুদ রঙের বিল্ডিংটি দেখা যাচ্ছে, ওটাই নাথাং রেসিডেন্সি। কিন্তু যাবো কী করে? সরাসরি তো যাবার কোনও রাস্তা দেখছি না – এদিকে বাঁশের বেড়া।

বৃদ্ধর সঙ্গী বললেন, এগিয়ে যাও, ওদিক থেকে রাস্তা আছে।

এগোতে গিয়ে মোড় মুড়তেই দেখলাম একটা ছোট্ট টিনের ঘর, তাতে কাঁচা হাতে লেখা নাথাং পুলিশ পোস্ট। যাক – এইখানেই ভালো করে জেনে নেওয়া যাবে।

মোটরসাইকেল থেকে নামলাম। কেউ কি আছে? সামনে ভারী তেলচিটে পর্দা ঝুলছে। কোই হ্যায়?

ভেতর থেকে একটা আওয়াজ এল, অন্দর আইয়ে।

একজনই পুলিশ। পুলিশ হবার কারণেই তিনি আমাকে কী নাম, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাবো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে ফেললেন নিজে উত্তর দেবার আগেই, আদারওয়াইজ তিনি বেশ হাসিখুশি লোক। বললেন, এই রাস্তাটা ধরে উঠে গিয়ে ডাইনে মুড়ে যাও, ঐ বাড়িটার সামনে পৌঁছে যাবে। বলে পারমিট স্লিপের একটা কপি চেয়ে নিয়ে রেখে দিলেন।

রাস্তা বলে যেটা দেখালেন, সেটা আসলে পাথর আর কাদা মাখানো একটা অস্থায়ী রাস্তা মত। তার ওপর দিয়েই নর্দমা চলে গেছে, অবশ্য নোংরা জল নয়, এমনিই জল বইছে। অফরোডিংই বলা যায়, সেইখানে তুললাম মোটরসাইকেল, এবং বাঁক ঘুরে আরও কয়েকটা এর বাড়ির দালান তার বাড়ির উঠোনের ওপর দিয়ে চালিয়ে আবার বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সামনে একটা বিস্তীর্ণ মাঠ।

সেই মাঠের প্রান্তে বিশাল একটা পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের মাথায় একটা সবুজ রঙের চালাঘর। সেই ঘরকে ঢেকে দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে মাঠের ওপর নেমে আসছে এক সুবিশাল মেঘের ঢল। হালকা ধূসর রঙের। ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে পাহাড়টা, চালাঘরটা …

DSC_0256.jpgDSC_0260.jpg

আমি ডানদিকে তাকালাম। বিল্ডিংটা আমার চোখের সামনেই, কিন্তু আগেপিছে এপাশে ওপাশে কোথাও নাথাং রেসিডেন্সি লেখা বোর্ড নেই। এবং কাছেপিঠে আবারও, কোনও লোক নেই কোথাও।

বিল্ডিংয়ের উঠোনে ইয়া একটা জাঁদরেল চেহারার মোরগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রায় আমার হাঁটুর সমান উঁচু। দু তিনটে লোমশ কুকুর। আর সামনে একটা দরজা। সেইখানে গিয়ে হাঁক মারলাম।

ভেবেছিলাম চুক আর গেকের বাবা-সদৃশ একটা লোক বেরিয়ে এসে বলবে, আমার ঘরে অতিথটা এল কে – কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই, দূরে কোথাও একটা গোম্ফা থেকে বোধ হয় মোটা স্বরের ঘণ্টা বাজছিল, কী রকম মনে হচ্ছিল ঘন্টাটা বলছে, তির-লিং-লিলি-ডং, তির-লিং-লিলি-ডং, তাইগার অরণ্যে তো আমি নেই, … দরজাটা তখনই খুলল।

তাদের কী বলব আমি? কী নাম দেব? মেঘবালিকা? হ্যাঁ, এই নামটাই সঠিক, তাদের দুজনের জন্য। দুটি অপরূপ সুন্দরী তরুণী বেরিয়ে এল, চোখে মুখে প্রশ্ন নিয়ে – ইয়েস?

বুকিংয়ের প্রিন্ট আউট আমার ব্যাগেই ছিল, বের করে দুই মেঘবালিকার একজনের হাতে দিলাম। তাদের ছোট্ট চোখে বিস্ময় ফুটল, লালচে গাল আরও একটু লাল হল, ইউ মেড বুকিং অনলাইন?

– হ্যাঁ, সেই আগস্ট মাসে বুকিং করে রাখা – আপনারা মেসেজ পান নি?

– না, আসলে এখানে তিন মাস আগে টাওয়ার ভেঙে যাবার পর থেকে আর বিএসএনএল সারাতে আসে নি, আমাদের গত তিন মাস ধরে এখানে ফোন বা ইন্টারনেটের কানেকশন নেই, আমরা কোনও খবরই তো পাই নি।

তা হলে উপায়?

নো প্রবলেম স্যার, এখানে আজ একজনও টুরিস্ট নেই, পুরো প্রপার্টিই খালি, আপনার থাকতে কোনও অসুবিধে হবে না, প্লিজ ওয়েট, আপনার ঘর খুলে দিচ্ছি।

আমি বানজি কর্ড খুলতে লাগলাম। দুই মেঘবালিকা নিপুণ গতিতে একদম সামনের একটা বড়সড় ঘর খুলে দিল, আমার হাত থেকে প্রায় ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ঘরের কোণে সাজিয়ে দিল – সামনের মাঠ তখন মেঘের পাঁজায় অদৃশ্য হয়ে আছে, বাইরে আমার মোটরসাইকেলের চারপাশে তদারকি করছে দুই লোমশ কুকুর আর সেই হাঁটু-সমান উঁচু মোরগ। আমি ঘরে ঢুকলাম। মোটরসাইকেল রইল ঘরের ঠিক সামনেই একটা ছাউনির নিচে।

DSC_0258.jpg

ধড়াচুড়ো ছেড়ে বসতে না বসতেই আবার দরজায় ঠকঠক। স্যর, চায় পিওগে? চায় লায়ি হুঁ।

অবশ্যই খাবো। বেশ দাঁত বসানো ঠাণ্ডা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল। খেয়ে নিয়ে একটু বেরোলাম হাঁটতে। সামনের মাঠটা আবার দৃশ্যমান হয়ে গেছে। মেঘ সরে গেছে কোথায় কে জানে। আকাশ এখন নীল, তাতে হাল্কা লালচে আভা ধরছে, সন্ধ্যে হবে একটু পরেই।

কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল। এত সুন্দর জায়গা এই নাথাং, জানলে অন্তত আরেকটা দিন থেকে যাওয়া যেত। কিন্তু কাল সকালেই আবার চলে যাওয়া। থামার উপায় নেই। নাথাং, যেন আমি নাথাং দেখব বলেই বাড়ি ছেড়ে এতদূরে এসেছি। বাকি সব, সব, গৌণ। গুরুদোংমার লেক, নাথুলা – সে তো সবাই দেখে। এই সৌন্দর্য, এ তো পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। ইস্ট সিকিম, অনেক, অনেক, অনেএক বেশি সুন্দর, বাকি সিকিমের থেকে।

ফিরে আসতেই দ্বিতীয় মেঘবালিকা আবার হাজির। চায় পিওগে? ফীলিং কোল্ড?

আমি এম্নিতে খুব একটা চাতাল নই, আর বাড়ির বাইরে চা খুব একটা খাইও না, কিন্তু এমন সুন্দরী মেঘবালিকাদের ‘না’ বলতে মন চাইল না। আবারও ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল, মেঘবালিকা তার টুকটুকে লাল গালে আরও লালচে আভা ছড়িয়ে বলল, আমরা না, এখানে জলদি ডিনার করে নিই, সাড়ে সাতটায় ডিনার বানিয়ে দেব?

ঠিক আছে, তাই দিও।

আপনি … চিকেন খাবেন তো স্যার? দেশি চিকেন?

এটাই বুঝি বাকি ছিল। যুগ যুগ ধরে ব্রয়লার চিবিয়ে ক্লান্ত দাঁত-জিভকে কি আর কেউ জিজ্ঞেস করে, দেশি চিকেন খাবেন কিনা? তাও এই নাথাংয়ে? মনের উল্লাস মনেই চেপে রেখে বললাম, নিশ্চয়ই খাব। রুটি আর চিকেন কোরো তা হলে।

চা শেষ করে … কী করা যায়? মোবাইলে সিগন্যাল নেই। পৃথিবী থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। অতএব, ল্যাপটপ খুলে বসলাম, সিনেমা দেখা যাক একটা।

ঠিক সাড়ে সাতটার সময়ে খাবার ডাক এল। পাশের ঘরে, যেইখানে দরজায় আমি প্রথম ডাক দিয়েছিলাম, সেই দরজার ভেতরেই ডাইনিং হল, পাশে কিচেন। কনকনে ঠাণ্ডাতে হাতে গড়া গরমাগরম রুটি আর ধোঁয়া ওঠা দেশি চিকেন, সাথে গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজ – সে যে কী অমৃত, কী অমৃত, সে আর আপনাদের কী বলব, আপনারাও নিশ্চয়ই খেয়েছেন কোথাও না কোথাও। পাশের ঘরে রুটি সেঁকতে সেঁকতে পরিশীলিত ইংরেজি উচ্চারণে এক মেঘবালিকা কোনও এক ইংরেজি গান ধরেছে, অপূর্ব সুরেলা আওয়াজ, আমি ইংরেজি গান বিশেষ শুনি না, তাই চিনতে পারলাম না, কেবল মনে আছে, বড় সুন্দর ছিল সেই সুর। রুটি দিতে আসার সময়ে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, তোমার গানের গলাটা তো খুব সুন্দর – আরেকটা গান শোনাবে?

মেঘবালিকা উত্তরে খিলখিলিয়ে হেসে এত বেশিমাত্রায় ব্লাশ করল যে তার সারা মুখ লাল হয়ে গেল। … আমি কি খুব বেশি প্রগলভ হয়ে যাচ্ছি? তড়িঘড়ি বললাম, ঠিক আছে, এখানে গাইতে হবে না, কিচেনে বসেই যেমন গাইছিলে, গাও, যদি তোমার ইচ্ছে হয়, আমার শুনতে খুব ভালো লাগছে।

মেঘবালিকা তাইই করল। কিচেনে বসে ধরল আরও একটা গান। আমি গান শুনতে শুনতে আটখানা রুটি খেয়ে ফেলে, তারপরে সেটা বুঝতে পেরে নিজেই লজ্জিত হয়ে খাওয়া থামিয়ে দিলাম।

হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা বাইরে, ঘরের ভেতর দারুণ কোজি। তবু, ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। আর তো কিছু করার নেই, ঘুমোনোই বাকি শুধু। আর এক চক্কর মেরে আসি। … মাঠের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝকমকে কালো আকাশ, নক্ষত্রখচিত। কালপুরুষ দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে রইলাম।

সিকিমে আজই আমার শেষ রাত্রি। কাল থেকে অন্য দিকে, নতুন এক জার্নির শুরু। প্রতিটা ইন্দ্রিয় দিয়ে, প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে শুষে নিতে চাইছিলাম এই সৌন্দর্য, আর কখনও এখানে আসা হবে কিনা জানি না, কবে আসব, আদৌ আসব কিনা – সে প্রশ্ন এখন মুলতুবি থাক, নাথাং, তোমায় আমি ভুলব না। সিকিম আমার মন ভরিয়ে দিল – অপূর্ব। অসাধারণ।

তখনও কি জানি, আরও কত সৌন্দর্যের পসার আমার সামনে মেলে ধরবে ইস্ট সিকিম, পাকাপাকি ভাবে তাকে ছেড়ে চলে আসার আগে?

সে গল্প পরের পর্বে।


3 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৯

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.